বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের উপযুক্ত সেবা থেকে খুলনার ৯টি উপজেলার ২০ লাখ মানুষ বঞ্চিত।
এ উপজেলাগুলোতে ৮৪ টি জুনিয়র কনসালট্যান্টের পদ থাকলেও চিকিৎসা দিচ্ছেন মাত্র ২৭ জন। তার মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উপকূলীয় চার উপজেলায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট সবচেয়ে বেশি। উপজেলাগুলোতে পদায়নকৃত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দায়িত্ব পালনে চরম অনীহা দেখা গেছে। অনেকে সপ্তাহে তিন থেকে চারদিন দায়িত্ব পালন না করেও কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে বেতন নিচ্ছেন পূর্ণ মাসের। রেফার্ডকৃত অধিকাংশ রোগীরা অর্থাভাবে শহরে চিকিৎসা নিতে হিমসিম খাচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি দূর্ভোগের শিকার হচ্ছেন গর্ভবতী ও শিশুরা। দুই’একটি উপজেলায় সার্জারী ও অর্থোপেডিক্স বিশেষজ্ঞ থাকলেও কোনটিতে নেই চক্ষু, ইএনটি, কার্ডিওলজি এবং চর্ম ও যৌন বিশেষজ্ঞ।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, ৫টি ইউনিয়ন নিয়ে খুলনা শহর লাগুয়া রূপসা উপজেলা। রূপসায় ১০টি পদের বিপরীতে গাইনি, মেডিসিন ও শিশু বিশেষজ্ঞ রয়েছে। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মামুনি সুলতানা সপ্তাহে মাত্র তিন দিন রোগী দেখেন। বাকী তিনদিন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে খুলনা জেনারেল হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেন। জুনিয়র কনসালট্যান্ট (এনেস্থেসিয়া) ডা. এ এফ এম আশিকুল হক প্রেষণে খুলনা মেডিকেল কলেজ এ- হাসপাতালে রয়েছেন।
গর্ভবতীদের জরুরী সি-সেকশন বন্ধ থাকলেও সপ্তাহে একদিন অস্ত্রোপচার চালু রাখা হয়েছে। তবে প্রতিটি সি-সেকশনের জন্য চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তবে এ উপজেলার অন্য উপজেলায় আরও বেশি টাকা নিয়ে সিজার করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক ব্যাক্তি বলেন,
মাঝে মধ্যে গর্ভবতীদের অপারেশন করা হলেও জরুরি সিজারের ব্যবস্থা না থাকায় দূর্ভোগ পোহাতে হয়।
আর যদি সিজার করা হয় তাহলে টাকা দিয়ে সিজার করাতে হয়। আর টাকা না দিলে সিজার করেন না।
জেলা শহর থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী সুন্দরবনের কোলঘেষাঁ ৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত কয়রা উপজেলা। বার বার প্রাকৃতিক দূর্যোগে বিধ্বস্ত এ উপজেলার প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ দরিদ্র। যাতায়াত ব্যবস্থা লাজুক হওয়ায় দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়ন থেকে জেলা শহর খুলনায় পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ১০ ঘন্টা। কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জুনিয়র কনসালট্যান্টের ১০টি পদ থাকলেও রয়েছে শুধু গাইনি ও এনেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞ। শিশু বিশেষজ্ঞ না থাকায় শহরে চিকিৎসা নিতে হিমসিম খেতে হয় অভিভাবকদের। খরচের ভয়ে অধিকাংশ শিশুর অভিভাবক শরানাপন্ন হচ্ছেন পল্লী চিকিৎসকের কাছে। ফলে অপচিকিৎসার শিকার হয়ে মারাত্নক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। এদিকে, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফাতেমা জোহরা সপ্তাহে মাত্র দুই দিন দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাকী ৪ দিন হাসপাতালে না আসলেও বেতন তুলছেন পূর্ণমাসের। যোগদানের ৫ মাস অতিবাহিত হলেও করেননি কোন অস্ত্রোপচার।
ফলে গর্ভবতীদের জরুরী সি-সেকশনের প্রয়োজন হলে পড়তে হচ্ছে চরম বিপাকে। এ ছাড়া মাত্র চার জন মেডিকেল অফিসার দিয়ে চলছে আড়াই লক্ষাধিক মানুষের স্বাস্থ্য সেবা। মূল ভবন ভেঙে ফেলায় রয়েছে চরম শয্যা সংকট।
কয়রার পশ্চিম দেয়াড়া একতা সংঘের সহ-সভাপতি মো: মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, উপকূলের নারীরা লবনাক্ততার প্রভাবে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বহুদিন পরে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পদায়নে বেজায় খুশি হই আমরা। তবে তার সেবা পাওয়া দুস্কর। উপকূলের নারীরা কাঙ্খিত চিকিৎসা না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গর্ভবতীদের জরুরী সিজারের প্রয়োজন হলে বিপাকে পড়তে হয়। আর একজন শিশু বিশেষজ্ঞও খুবই জরুরী।
কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রেজাউল করিম জানান, জুনিয়র কনসালট্যান্ট (গাইনি) ডা. ফাতেমা জোহরার অনুপস্থিতির বিষয়ে পরিচালককে অবগত করা হয়েছে। অপারেশন থিয়েটরে জেনারেল এনেস্থেসিয়া (জিএ) মেশিন না থাকায় গাইনি চিকিৎসক ওটি করেন না।
একটি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে পাইকগাছা উপজেলা গঠিত। সেখানকার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০টি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ থাকলেও শুধুমাত্র স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছে। তিন লক্ষাধিক মানুষের জন্য রয়েছে মাত্র ৭ জন মেডিকেল অফিসার। ওটি চালু থাকলেও গর্ভবতীদের জরুরী সি-সেকশনের প্রয়োজন হলে প্রাইভেট ক্লিনিকে পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া শিশু চিকিৎসায় চরম বেগ পেতে হয় অভিভাবকদের।
একটি পৌরসভা ও ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে সুন্দরবন উপকূল ঘেষাঁ উপজেলা দাকোপ। দাকোপে ১০ টি পদের বিপরীতে শুধু গাইনি, অর্থোপেডিক্স ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সেবা দিচ্ছেন। সেখানে জুনিয়র কনসালট্যান্ট (এনেস্থেসিয়া)
পদে ডা. শেখ আওরঙ্গজেব প্রিন্সের পদায়ন থাকলেও
প্রেষণে তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তবে এনেস্থেসিয়া প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন মেডিকেল অফিসার থাকায় গর্ভবতীদের সি-সেকশন চালু রয়েছে। তবে শিশুরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা বঞ্চিত। দুই লাখ মানুষকে ৮ জন মেডিকেল অফিসার নিয়মিত চিকিৎসা সেবা দিতে হিমসিম খাচ্ছে।
৭টি ইউনিয়নের দুই লাখ মানুষের বসবাস বটিয়াঘাটা উপজেলায়। বটিয়াঘাটায় ৪টি পদের বিপরীতে গাইনি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ রয়েছে। তবে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ থাকলেও এনেস্থেসিস্টের অভাবে গর্ভবতীদের সি-সেকশন সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। ফলে গর্ভবতীদের দূর্ভোগের অন্ত নেই। বিশেষজ্ঞের সেবা বঞ্চিত শিশুরাও। মাত্র ৭ জন মেডিকেল অফিসার চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। বটিয়াঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ২০১৮ সালে ৫০ শয্যার অনুমোদন পেলেও অদ্যাবধি জনবলের অনুমোদন পাননি। ৩১ শয্যার জনবল দিয়ে ৫০ শয্যার সেবা কার্যক্রম চালাতে ব্যহত হচ্ছে বলে জানান বটিয়াঘাটা উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোঃ মিজানুর রহমান। খুলনা শহরের সন্নিকটে ৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ফুলতলা উপজেলা। সেখানে ১০টি পদের বিপরীতে গাইনি, মেডিসিন ও শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন। এনেস্থেসিস্ট না থাকায় গর্ভবতীদের সি-সেকশন বন্ধ রয়েছে। তবে মাঝে মধ্যে ডেপুটি সিভিল সার্জন যেয়ে এনেস্থেসিষ্টের দায়িত্ব পালন করলে দু'এক জনের অপারেশন করা হয়। জুনিয়র কনসালট্যান্ট (অর্থোপেডিক্স) ডা. মোঃ ইমরান এবং জুনিয়র কনসালট্যান্ট ( চক্ষু) ডা. সত্যজিত মন্ডল খুলনা জেনারেল হাসপাতালে পূর্ণকালীন প্রেষণে যুক্ত রয়েছেন।
৬টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত তেরখাদা উপজেলা। সেখানে দেড় লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। তেরখাদায় ১০টি পদের বিপরীতে শুধু গাইনি, এনেস্থেসিয়া ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ রয়েছে। গর্ভবতীদের সিজারের ব্যবস্থা থাকলেও শিশু বিশেষজ্ঞ না থাকায় নবজাতকের চিকিৎসায় সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে নবজাতক খুলনায় রেফার্ড করলে অভিভাবকদের চরম বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
খুলনা মহানগরীর সাথে যুক্ত উপজেলা দিঘলিয়া। ৬টি ইউনিয়নে প্রায় দুই লাখ মানুষের বসবাস। এ উপজেলায় শিশু, মেডিসিন, গাইনি, সার্জারী ও এনেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকলেও ওটি প্রস্তুত না থাকায় গর্ভবতীদের সিজারসহ কোন মেজর অপারেশন হয়না। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সোহেলী শারমিন প্রেষণে সপ্তাহে তিন দিন খুলনা জেনারেল হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেন। আর এনেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞ ডা. পলাশ কুমার দে প্রেষণে সপ্তাহে চার দিন খুলনা মেডিকেল কলেজ এ- হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছেন। সার্জারী বিশেষজ্ঞ ডা. মোঃ ফয়জুর রহমান দুই দিন দিঘলিয়ায় আর বাকি চারদিন খুলনা মেডিকেল কলেজ এ- হাসপাতালে কাজ করেন।
খুলনা মহানগরীর সন্নিকটে ১৪টি ইউনিয়নের সাড়ে তিন লাখ মানুষ নিয়ে গঠিত ডুমুরিয়া উপজেলা। ডুমুরিয়ায় মেডিসিন, সার্জারী, গাইনি, শিশু ও এনেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে অধিকাংশ সময় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা হাজিরা দিয়ে শহরে চলে যায়। সেখানে নিয়মিত রোগী দেখেন না। অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শেখ সুফিয়ান রুস্তুম বলেন, পাঁচ জনকে একসাথে বসার জায়গা দিতে পারিনা। তবে তারা হাসপাতালে থাকেন।
খুলনার সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ বলেন, দায়িত্ব অবহেলার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। শূণ্য পদের চাহিদা পাঠানো রয়েছে।
খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মোঃ মনজুরুল মুরশিদ বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কনসালট্যান্টের পদায়ন দেয়া হয়। এখানে আমাদের কোন হাত নেই। আর দায়সারা সেবার বিষয়ে বলেন, আমাদের জানা নেই, তথ্য দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।