না ফেরার দেশে চলে গেলেন খুলনার পাইকগাছায় কপিলমুনি কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানের প্রাক্তন অধ্যাপক কালিদাস চন্দ্র চন্দ। কয়েক দিন আগে অসুস্থ হয়ে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে আইসিইউ তে থাকাবস্থায় ১৬ জুন ভোর ৪টা ৪৫ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি স্থানীয় বিভিন্ন শিক্ষা, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। শিক্ষকতা জীবনে তিনি বহুবার উপজেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মর্যাদা লাভ করেন। কালিদাস চন্দ্র ১৯৫০ সালের ২০ নভেম্বর খুলনার পাইকগাছা উপজেলার হরিঢালী গ্রামে এক সম্ভ্রাস্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শ্রীযুক্ত সুধীর কৃষ্ণ চন্দ্র ও মাতা শ্রীমতী সরলা বালা চন্দ্র। শিক্ষা জীবনে স্থানীয় হরিদাশকাটি প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে তার হাতে খড়ি। সেখান থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে হরিঢালী ইউনিয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও পরে কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দির হতে মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৬ সালে কপিলমুনি সহচরী বিদ্যা মন্দির হতে এসএসসি, ১৯৬৮ সালে সাতক্ষীরা কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৭১ সালে স্কলারশীপ নিয়ে সরকারি ব্রজলাল কলেজ হতে বিএসসি (সম্মান) পাশ করেন। প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীণ শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় গ্রহণ করে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিতি রেজিস্ট্রেশন করেন এবং ক্যাম্প কমান্ডার খায়বার হোসেন পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাট মহাকুমার টেট্ রা মুক্তি ফৌজের রিসিপশন ক্যাম্পে অফিশিয়াল পদে কর্মরত হন। এরপর যুদ্ধ শেষে তিনি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত বিএসসি (সম্মান) পরীক্ষা-১৯৭১ এ অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে তিনি আবারও সরকারি স্কলারশীপ নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণীতে এমএসসি সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৭৪ সালের ৬ জুলাই তিনি পাইকগাছার কপিলমুনি কলেজে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হিসাবে যোগদান করে দীর্ঘ ৩৬ বছর ৪ মাস ১৪ দিন সুনামের সাথে অধ্যাপনা করে ২০১০ সালের ১৯ নভেম্বর অবসর গ্রহণ করেনে। এরপর তাঁকে ওই কলেজের পরিচালনা পরিষদের শিক্ষানুরাগী সদস্য হিসেবে মনোনীত করা হয়। উল্লেখ্য অধ্যাপনা জীবনে তিনি প্রায় ৩০ বছর যাবৎ যশোর শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষক এবং ৩ বছর প্রধান পরীক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সালে নিজ এলাকার জয়দেব কুমার ভদ্রের নেতৃত্বে মানিক ভদ্রসহ গ্রামের এক দল মেধাবী ছাত্র একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার জন্য তার মতামতসহ বাস্তবায়নের জন্য ব্যবস্থা করতে বলেন। এরপর ১৯৯০ সালের ১০ই ডিসেম্বর মাহমুদকাটি হরিসভা প্রাঙ্গণে লাইব্রেরী বাস্তবনে একটি সাধারণ সভার আয়োজন করা হয়। অধ্যাপক কালিদাস চন্দ্র চন্দ্রের সভাপতিত্বে সোনালী সভায় আত্মপ্রকাশ ঘটে দেশের অন্যতম প্রধান গ্রামীণ পাঠাগার অনির্বাণ লাইব্রেরির। তিনি লাইব্র্ররির প্রতিষ্ঠা সভাপতি হিসাবে ১৯৯০ সাল হতে ২০০১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১১বছর দায়িত্ব পালন করেন। এসময়ে লাইব্রেরির গঠনতন্ত্র প্রনয়নে নেতৃত্ব দেন। ২০২০ সাল ১লা জানুয়ারি সময়ের প্রয়োজনে তাকে ফের লাইব্রেরীর কার্যকরী পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিদায় নেন তিনি। এ সময় অনির্বাণ লাইব্রেরী আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে বিদায় সম্মাননা জানায়। সাথে সাথে এর পথিকৃৎ হিসেবে অনির্বাণের আধুনিক মিলনায়তনের নামকরণ করা হয় তাঁর নামে। ১৯৭৮ সালে তিনি মাহমুদকাটি গ্রামে বিশিষ্ট স্বর্ণ ব্যবসায়ী জয়দেব দত্তের কন্যা ভারতী দত্ত কে বিয়ে করেন তিনি। দাম্পত্য জীবনে তিনি চার মেয়ের জনক। কন্যা ও জামাতারা হলেন: ১. ডাঃ মহুয়া চন্দ্র, এমবিবিএস, বিসিএস (হেলথ), এফসিপিএস বর্তমান সলিমুল্লাহ মেডিকেলে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত রয়েছেন তিনি। তার স্বামী ডাঃ প্রভাত সরকার এমবিবিএস, বিসিএস (হেলথ), এমসিপিএস (মেডিসিন), এমডি (নিউলোজি) বর্তমানে বাংলাদেশ নিউরো সায়েন্সস এ- হসপিটাল এ সহকারী অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত আছেন। ২. ডাঃ পম্পা চন্দ্র, এমবিবিএস, বিসিএস (হেলথ) এফসিপিএস বর্তমানে তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজে অফিসার হিসাবে কর্মরত রয়েছেন। তার স্বামী ডাঃ মিলন চৌধুরী এমবিবিএস, বিসিএস (হেলথ) এফসিপিএস (ইএনটি) বর্তমানে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে হেডনেক সার্জন হিসাবে কর্মরত আছেন। ৩.মৌমিতা চন্দ্র বর্তমানে সৌনালী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এ প্রিন্সিপাল অফিসার হিসাবে কর্মরত রয়েছেন। স্বামী ডাঃ কল্যাণাশীষ সরদার এমবিবিএস, বিসিএস (হেলথ), এফসিপিএস (মেডিসিন), ইনি বর্তমানে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজে কনসালটেন্ট হিসাবে কর্মরত রয়েছেন। ৪.কুসুম কেয়া চন্দ্র, ২০১৯ সালের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ ৫ ও স্কলারশীপ অর্জন করে। বর্তমানে ৯ম শ্রেণীর ছাত্রী। শুক্রবার ভোর পৌনে ৫ টায় মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় দীর্ঘ দিনের কর্মস্থল কপিলমুনি কলেজে। সেখানে তার সহকর্মীসহ শিক্ষক-কর্মচারী ও পরিচালনা পরিষদের সদস্যরা ফুল দিয়ে তাকে শ্রদ্ধা জানান। এরপর তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান অনির্বাণ লাইব্রেরী চত্ত্বরে। সেখানে সর্বস্তরের মানুষের শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হয়। এদিকে প্রিয় শিক্ষকের মৃত্যুতে শোক ও শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন সর্বস্তরে মানুষ।