সাতক্ষীরায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে প্রশাসন কঠোর অবস্থানে থাকলেও তা ঠেকানো যাচ্ছে না। গোপনে বাল্যবিবাহ হচ্ছে। সোমবার ও শুক্রবার সপ্তাহের এ দুদিন বাল্যবিবাহের আয়োজন করা হয়। তবে অন্যান্য বারেও বাল্যবিবাহের আয়োজন করা হয় হয় বলে সূত্র জানায়। বাল্যবিবাহের আয়োজনে খবর পেয়ে মাঠে নামে প্রশাসন। বৃহস্পতিবার একদিনেই তিনটি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রশাসন। এরমধ্যে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় একটি এবং তালা উপজেলায় দুটি বাল্যবিবাহে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। সূতমতে, বৃহস্পতিবার সাতক্ষীরার তালা উপজেলার পল্লীতে একদিনে দুই কিশোরীর বাল্যবিবাহ বন্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এ সময় এক কিশোরীর মাকে ৫ হাজার টাকা এবং বাল্যবিবাহের আয়োজনে সহযোগিতার জন্যে শেখ মোঃ কামাল উদ্দীন নামের আরেক ব্যক্তিকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। বৃহস্পতিবার (৬ জুলাই) বিকালে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও তালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আফিয়া শারমিন পৃথকভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে এই রায় ঘোষণা করেন।
তালা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নাজমুন নাহার জানান, বৃহস্পতিবার (৬জুলাই) তালা সদর ইউনিয়নের মুড়াকালিয়া গ্রামে দশম শ্রেণির এক ছাত্রীর বিয়ে আয়োজন চলছিল। এ সময় মহিলা বিষয়ক অফিসের আবৃত্তি শিক্ষক আসাদুল ইসলাম ও ভিডব্লিউবি প্রশিক্ষক রাজিবুল ইসলাম সেখানে হাজির হয়। রান্নার কাজও শেষ পর্যায়ে ছিল। এ সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও তালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আফিয়া শারমিন। প্রসিকিউশন দেন মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নাজমুন নাহার।
তালা থানার এসআই রাজিবের নেতৃত্ব পুলিশের একটি টিম সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় বাল্যবিবাহের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি, মেয়ের মায়ের মুচলেকা গ্রহণসহ তাকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা এবং বাল্যবিবাহের আয়োজনে সহযোগিতার জন্যে শেখ মোঃ কামাল উদ্দীন নামের আরেক ব্যক্তিকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমান আদালত। পরবর্তীতে রান্না করা পাঁচ হাড়ি খাবার পার্শ্ববর্তী এতিমখানায় পাঠানো হয়।
এদিকে একইদিনে উপজেলার কুমিরা গ্রামে এক কিশোরীর বাল্যবিবাহ বন্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এ সময় ঐ কিশোরীর পিতা মুচলেকা দিয়েছেন। কুমিরা ইউনিয়ন কিশোর-কিশোরী ক্লাবের সংগীত শিক্ষক শম্পা ভট্টাচার্য ও আবৃত্তি শিক্ষক আনিছা খাতুন ওই কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। তালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আফিয়া শারমিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এর আগের দিন ৫ জুলাই তালায় দশম শ্রেণির ছাত্রীকে বিবাহ করার দায়ে বর সুমন মোড়ল রাসেলকে ১৫দিনের কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। বর সুমন মোড়ল তালা উপজেলার ইসলামকাটী ইউনিয়নের উথালী গ্রামের বিল্লাল হোসেন মোড়লের ছেলে। এ সময় ওই জরিমানার টাকা পরিশোধ না করলে আরও ৪দিনের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। বুধবার (৫ জুলাই) বিকালে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও তালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আফিয়া শারমিন ওই রায় ঘোষণা করেন। তালা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নাজমুন নাহার জানান, ২/৩ দিন আগে উপজেলার বারাত এলাকার দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকে বিয়ে করে সুমন মোড়ল রাসেল। বুধবার ছিল তাদের বাড়িতে বৌভাত অনুষ্ঠান।
এদিকে বৃহস্পতিবার (৬ জুলাই) সাতক্ষীরা সদরের ধুলিহর ইউনিয়নের বেড়বাড়ী এলাকায় অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলের বৌ'ভাত অনুষ্ঠান মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব ফাতেমা-তুজ-জোহরা।
ভ্রাম্যমাণ আদালতে ছেলের বাবাকে ৮ হাজার টাকা জরিমানা (অনাদায়ে ১৫ দিনের জেল, জরিমানার টাকা পরিশোধ) করা হয়। সদর উপজেলার আলীপুর আজিজীয়া দাখিল মাদ্রাসায় ৮ম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছাত্রী ১৪ বছরের মেয়েকে তার বাবার মুচলেকা নিয়ে বাড়ি একই উপজেলা আলিপুর গ্রামে ফেরত পাঠানো হয়।
এর আগে গত ৯জুন (শুক্রবার) সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় দুটি বাল্যবিবাহ বন্ধ করে উপজেলা প্রশাসন। এদিন জুমার নামাজের পর তালার জালালপুর ও সরুলিয়া ইউনিয়নে বিয়ে দুটির আয়োজন করা হয়েছিল। জালালপুর ইউনিয়নে বাল্যবিবাহ আয়োজন করার দায়ে কনের বাবাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফিয়া শারমিন। উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা নাজমুন নাহার প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ৯জুন বেলা দুইটার দিকে জালালপুর ইউনিয়নে অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীর (১৩) সঙ্গে একই এলাকার উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রের (১৯) বিয়ের আয়োজন করে দুই পরিবার। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের কিশোর-কিশোরী ক্লাবের একাধিক কর্মকর্তা ও পুলিশ পাঠানো হয়। জন্মসনদে তাঁরা দেখেন, কনের বয়স ১৩ ও বরের বয়স ১৯ বছর। এদিন সুরুলিয়া ইউনিয়নে দশম শ্রেণির এক ছাত্রীর (১৫) বাল্যবিবাহের আয়োজন করা হচ্ছে, এমন খবর পেয়ে আজ দুপুরে সেখানে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের কিশোর-কিশোরী ক্লাবের একাধিক কর্মকর্তা ও পুলিশ পাঠানো হয়। ওই বাড়িতে গিয়ে কনের জন্মসনদ দেখতে চান তাঁরা। জন্মসনদে দেখা যায়, কনের বয়স ১৫ বছর। ঘটনাস্থলে পুলিশসহ অন্যান্যের উপস্থিতির খবর পেয়ে বরপক্ষ মাঝপথ ফিরে যায়। পরে কনের বাবা ভুল স্বীকার করে ১৮ বছর বয়সের আগে মেয়েকে বিয়ে দেবেন না বলে মুচলেকা দেন।
সূত্রমতে, ২জুন (শুক্রবার) সাতক্ষীরার তালা উপজেলার ইসলামকাটি ইউনিয়নের চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রী নিজের বুদ্ধিতে বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা পায়। ওইদিন রাতে ওই ছাত্রীর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে সে উপজেলা প্রশাসনের কাছে খবর পাঠায়। এরপর সকালে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের কিশোর-কিশোরী ক্লাবের আবৃত্তিশিক্ষক ওই বাড়িতে যান। একপর্যায়ে ওই শিক্ষকের সঙ্গে ওই ছাত্রী বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ওই ছাত্রী বৃহস্পতিবার রাতে তাদের কাছে গোপনে খবর পাঠায় যে তার বাবা বিয়ে ঠিক করেছেন। রাতে তার বিয়ে হতে যাচ্ছে। এরপর সকাল সাড়ে আটটার দিকে ইসলামকাটি ইউনিয়নের কিশোর-কিশোরী ক্লাবের আবৃত্তিশিক্ষক শেফালি দাসকে ওই বাড়িতে পাঠানো হয়। তিনি ওই বাড়িতে গিয়ে ঘটনার সত্যতা পান। এদিকে শেফালির উপস্থিতি টের পেয়ে ছাত্রীর বাবা গা ঢাকা দেন। একপর্যায়ে ওই ছাত্রী শেফালি দাসের সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে চলে আসে। পরে ইসলামকাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক ওই ছাত্রীর বাড়িতে গিয়ে ঘটনার সত্যতা পান।এরপর বিষয়টি তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও তালা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে জানানো হয়।
এদিকে গত ১৫ মে সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় দশম শ্রেণির এক ছাত্রী ও এইচএসসির এক ছাত্র বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা পায়। উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে ১৫ মে (সোমবার) দুপুরে তাদের বাল্যবিবাহ বন্ধ করা হয়।
তালা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নাজমুন নাহার জানান, উপজেলার জালালাবাদ ইউনিয়নে চলমান এসএসসি পরীক্ষার এক ছাত্রীর বাল্যবিবাহের তোড়জোড় চলছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে ২৫ মে দুপুর ১২টার দিকে তালা মহিলা অধিদপ্তরের জেন্ডার প্রমোটার নাজমুল হাসান ও তালা থানার উপরিদর্শক (এসআই) ইমন হাসানের নেতৃত্বে কয়েকজন পুলিশকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। তারা সেখানে গিয়ে শোনে ছাত্রীকে পড়ার টেবিল থেকে জোর করে তুলে নিয়ে অভিভাবকেরা পার্শ্ববর্তী গ্রামে বরের বাড়িতে নিয়ে গেছেন। তাঁরা সেখানে গিয়ে দেখেন বাল্যবিবাহের তোড়জোড় চলছে।
নাজমুল হাসান ও ইমন হাসানসহ অন্যরা ঘটনাস্থলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকেরা ছাত্রীকে লুকিয়ে ফেলেন। চেষ্টা করেও ওই ছাত্রীকে পাওয়া যায়নি। একপর্যায়ে বরসহ তার বাবা-মাকে আটক করে নিয়ে আসা হয় তালা উপজেলা পরিষদে। সেখানে বরপক্ষ বিয়ের আয়োজনের কথা স্বীকার করে মুচলেকা দেয়, ওই মেয়ের বয়স ১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত তাদের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবে না। এমনকি ১৮ বছরের আগে যদি ছাত্রীর অভিভাবক কোথাও বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, তারা প্রশাসনকে জানাবে।
নাজমুন নাহার আরও জানান, তাঁরা জানতে পারেন ১৫ মে দুপুরে মাগুরা ইউনিয়নে ১৯ বছর এইচএসসি পরীক্ষার্থী এক ছেলের খুলনার ডুমুরিয়া ইউনিয়নে এক ছাত্রীর সঙ্গে বিয়ের আয়োজন করা হয়। বরযাত্রীরা বিয়েতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এমন খবর পাওয়ার পর কিশোর-কিশোরী ক্লাবের আবৃত্তি শিক্ষক আসাদুল ইসলাম ও তালা থানার পরিদর্শক ইমন হাসানের নেতৃত্বে কয়েকজন পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে যান। সেখানে গিয়ে তাঁরা দেখেন বরসহ বরযাত্রী ডুমুরিয়ায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। এ সময় বরের জন্মসনদ দেখেন বয়স ১৯ বছর। বরসহ তাঁর অভিভাবকদের তালা উপজেলা পরিষদে নিয়ে আসা হয়। স্থানীয় ইউপি সদস্য মইনুল ইসলাম ও বরের মা মুচলেকা দিয়ে বলেন, ওই ছেলেকে ২১ বছর বয়সের আগে বিয়ে দেবেন না।
বাল্য বিবাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে মানবাধিকার কর্মী মাধব চন্দ্র দত্ত সম্প্রতি একটি জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে বাল্য বিয়ের হার সবচেয়ে বেশি। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীব্যাপী বাল্য বিবাহ একটি মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর সারাবিশ্বে ১৮ মিলিয়ন মানুষ বাল্য বিয়ের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশে বাল্য বিয়ের হার ৫২ শতাংশ। খুলনা বিভাগে বাল্য বিয়ের হার ৭১ শতাংশ ও সাতক্ষীরায় এই হার ৭২ শতাংশ। বাংলাদেশে বাল্য বিয়ের গড় বয়স ১৫ বছর। যাদের প্রথম বাচ্চা জন্মদানের গড় বয়স ১৭ বছর। বিভিন্নন কারণে বাল্যবিবাহ হচ্ছে। এরমধ্যে অভিভাবকদে সচেতনতার অভাব, দারিদ্র্য, নিরাপত্তা, আস্থাহীনতা, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের অপব্যবহার ইত্যাদি দায়ী বলে মন্তব্য করেন তিনি।