তেঁতুলিয়ায় ধ্বংসের মুখে কাঞ্চন/বোম্বাই বাঁশ শিল্প। ভিন্ন প্রজাতির বাঁশ চাষাবাদ টিকিয়ে রাখার জন্য চাষীদের প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।
জানা যায় দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে ছায়া নিবিড় প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশে শারিয়ালজোত গ্রামটি অবস্থিত। গ্রামটির দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম তিনদিক ভারত সীমান্তের কাটাতারের বেড়া দ্বারা বেষ্টিত। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সংগে সংগে ভারতের সীমান্ত পোষ্টের লাইটগুলো জ্বলে উঠলে গ্রামটি রাতের জোসনা রাতের মত আলোকিত থাকে। যার পশ্চিমে ভারতের জলপাইগুরি জেলার ইসলামপুর ও চপড়া থানা এবং দক্ষিণে উত্তরের জেলা দিনাজপুর। শাড়িয়ায়জোত গ্রামটি দেখতে অনেকটা ‘ব’ অক্ষরের একটি দ্বীপের মত। গ্রামের লোকজন উত্তর দিকের প্রবেশ দ্বার তেঁতুলিয়া উপজেলা সদরে পৌছে। সীমান্তবর্তী গ্রাম হলেও শারিয়ালজোত গ্রামে কাঁঞ্চন বা বোম্বাই বাঁশ আর মৌসূমি শীতকালীন বিদেশী টিউলিপ ফুলের চাষ হওয়ায় এখন দেশের মানুষের কাছে গ্রামটি বেশ পরিচিতি। তেঁতুলিয়া উপজেলার উঁচু বালুময় জমিতে গ্রামটির অবস্থান হওয়ায় এখানে সমতলে চা চাষ শুরুর আগে আখ, আনারস ও প্রচুর শাক সবজি¦ চাষাবাদ হত। এই গ্রামের উৎপাদিত শাক সবজি দ্বারা উপজেলার বেশির ভাগ জনসাধারণের চাহিদা পূরণ হয়। কিন্তু অত্র অঞ্চলের সমতল ভূমিতে সবুজ চা আবাদ বিস্তৃতি লাভের কারণে এখন আখ ও আনারস আবাদ বিলুপ্ত হয়েছে। জমির অভাবে কমেছে সবজি¦ চাষাবাদ। শাড়িয়ালজোত গ্রামের উৎপাদিত হচ্ছে কাঁঞ্চন বা বোম্বাই বাঁশ নামের একধরণের ভিন্ন প্রজাতির বাঁশ। বাঁশটি প্রায় ২০-২২ ইঞ্চি প্রস্থ এবং ১০০-১৫০ ফিট দৈর্ঘ্য হয়ে থাকে। দেখতে অনেকটা সুপারির গাছের চেয়েও মোটা। ভারতের লোকজনের কাছে বম্বাই বাঁশ নামে পরিচিতি হলেও তেঁতুলিয়া অঞ্চলে কাঞ্চন বাঁশ নামে পরিচিত। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে শারিয়ালজোত গ্রামের মৃত সরাফত আলী ভারতের চপড়া থানা এলাকা থেকে নিয়ে আসে। সর্বপ্রথম তার বাড়িতেই এই নতুন বাঁশের আবির্ভাব হয়। পরবর্তীতে তাঁর মাধ্যমে তেঁতুলিয়া উপজেলা সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বোম্বাই বাঁশের বিস্তৃতি লাভ করে। চাষীদের মুখে জানা যায় বোম্বাই বাঁশের চারা বের হওয়ার ৬ মাসের মধ্যে পুর্ণতা আসে এবং যে কোন কাজে ব্যবহার করা যায়। বাজারে প্রতিটি বাঁশ ২০০-৩০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। কাঞ্চন বা বোম্বাই বাঁশ দিয়ে ঘরের সৌখিন আসবাবপত্র সহ নানা রকমের কাজে ব্যবহার হয়। ইতোমধ্যে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা একাধিকবার শারিয়ালজোত গ্রামে এসে কাঞ্চন বাঁশের খবর প্রচার করায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন ওই গ্রামে এসে কাঞ্চন বাঁশের প্রতি পিচ চারা ৫০০-৭০০ টাকা মূল্যে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত কাঁঞ্চন বাঁশের চারা পাওয়া যাবে। কাঞ্চন বাঁশ এক নজর দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন স্কুল,কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক সহ পর্যটকরা শারিয়ালজোত গ্রামে আসেন। প্রতি সপ্তাহে দেশের দূর-দূরান্তের সৌখিন আসবাবপত্র তৈরির কারীগর ও ব্যবসায়ীরা দূরপাল্লার কোচ, ট্রাক ও মিনিবাস যোগে কাঞ্চন বাঁশ নিয়ে যান। বর্তমানে তেঁতুলিয়ার দর্জিপাড়া, চিমনজোত, মাগুড়া, সাহেবজোত, তিরনইহাট, বাংলাবান্ধা সহ পঞ্চগড়ের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজনের বাড়িতে কাঁঞ্চন বাঁশ চাষাবাদ হচ্ছে। দেশে-বিদেশে কাঞ্চন বাঁশের তৈরি ঘরের সৌখিন আসবাবপত্রের কদর দিনদিন বৃদ্ধি পাঁচ্ছে। কিন্তু বিপুল সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকা তেঁতুলিয়ায় সরকারি বা বেসরকারিভাবে বোম্বাই/ কাঞ্চন বাঁশ দিয়ে তৈরি ঘরের সৌখিন আসবাবপত্রের কোন কারখানা গড়ে না উঠেনি। বাঁশ চাষীরা সঠিক সময়ে বাঁশ বিক্রি দিতে না পাড়ায় ভিন্ন প্রজাতির বাঁশ গাছটির যত্ন পরিচর্চা দিনদিন কমায়ে ফেলেছে। অনেকে বড়বড় বাঁশ ঝাঁড় উপড়ে ফেলে অন্যান্য আবাদ করায় এই বাঁশের জাতটি দিনদিন হুমকীর পড়েছে। চাষীদের মতে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এঅঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে কাঞ্চন বাঁশের চাষ করা হলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে।
এব্যাপারে আঞ্চলিক বাঁশ গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, ডোমার, নীলফামারী এর গবেষণা কর্মকর্তা মোঃ আসাদুজ্জামান সরকার মুঠোফোনে এ প্রতিবেদককে জানান পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় বোম্বাই/কাঞ্চন জাতের ভিন্ন প্রজাতির একটি বাঁশ চাষাবাদ হয়ে থাকে। ওই বাঁশ ঘরের সৌখিন আসবাবপত্র তৈরির কাছে ব্যবহৃত হয়। এখনো এটি বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ শুরু করেনি। তবে আমাদের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাঁশ চাষীদের পরামর্শসহ ঘরের সৌখিন আসবাবপত্র তৈরিতে আগ্রহী যুবক/ব্যক্তিদের প্রশিক্ষন সহ টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিয়ে থাকি। যে কারণে বাঁশ গাছটি ধ্বংসের মুখে পড়ার সম্ভাবনা নাই। পর্যায়ক্রমে এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রসারিত হবে। তখন মানুষ বাঁশ শিল্পের সুফল পাবে।