ঝালকাঠির ছত্রকান্দায় নিয়ন্ত্রন হারিয়ে যাত্রীবাহী বাস বাশার স্মৃতি পরিবহন (ঢাকা মেট্রো-ব ১৪-৬৫৪৯) পুকুরে পড়ার ঘটনায় নিহত ১৭ জনের পরিবারের শোকের মাতম চলছে। শনিবার সন্ধ্যায় মরদেহ হস্তান্তরের পরে এদের যার যার বাড়িতে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোন মামলা দায়ের হয়নি। কিন্তু পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে মামলা দায়ের প্রস্তুতি চলছে। দোষী চালক, হেলপার ও সুপারভাইজারকে আইনের আওতায় এনে বিচার করা হবে। এদিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গঠন করা তদন্ত কমিটি ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে কাজ করছে। এ বাসের চালক মোহন, হেলপার বুলেট আশিক ও সুপারভাইজার মো. ফয়সাল ঘটনার পর থেকেই পলাতক রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাসটি পুকুর থেকে উদ্ধার করে ঝালকাঠি জেলা পুলিশ লাইন্সে রাখা হয়েছে।
নিহতদের মধ্যে দুইজনের বাড়ি জেলার কাঁঠালিয়া উপজেলায়। এরা হলো উপজেলার আনইলবুনিয়া গ্রামের তৈয়ব আলী খানের মেয়ে সালমা আক্তার মিতা(৪২) এবং দক্ষিণ কৈখালী গ্রামের মৃত কাঞ্চন তালুকদারের ছেলে মোঃ ফারুক তালুকদার(৪৮)। রাজাপুর উপজেলার দ:রাজাপুরের বলাইবাড়ি গ্রামের একই পরিবারের তিনজন নিহত হয়েছে। এরা হলো নুরুল ইসলামের মেয়ে আইরিন (২২), ছেলে নয়ন (১৬), নাতি ১৮ মাসের রিপা মনি। উপজেলার নিজামিয়া গ্রামের মাওলানা নজরুল ইসলামের স্ত্রী খাদিজা বেগম (৪৩), নজরুল ইসলামের মেয়ে খুশবো আক্তার (১৭)।
বাস দুর্ঘটনায় আহত ৩৫ জনের মধ্যে ৩৩ জন রোববার চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। ঝালকাঠি সদর হাসপাতাল ও বরিশালের শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল তারা চিকিৎসাধীন ছিল। আহত বাকি ২ জন মো. জলিল ও তার স্ত্রী মিনারা বেগম ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। তবে তাদের অবস্থা শংঙ্কামুক্ত বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। এছাড়াও বাস দুর্ঘটনার ২ দিনেও মামলা হয়নি।
এক সাড়িতে ৩টি কবর কেমনে দেখমু:
রোববার দুপুরে নিহত নুরুল ইসলামের বাড়ি গিয়ে দেখা যায় শোকের মাতম। সড়ক দুর্ঘটনায় তার ছেলে মেয়ে ও নাতি নিহত হয়েছে। পাশাপাশি কবরে শুয়ে আছে নুরুল ইসলামের ৩ স্বজন। তাদের স্বজনদের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে যায়। বারবার তাদের কথা বলে মুর্ছা যাচ্ছেন স্বজনেরা। পারিবারিক কবরস্থানের এক সাড়িতে ৩টি লাশ দাফন হয়েছে। তারা কান্না করছে আর বলছে এক সাড়িতে ৩টি কবর কেমনে দেখমু!। বাবার বাড়ি বেড়ানো শেষে মেয়ে ও ছোট ভাইকে নিয়ে তার শ্বশুর বাড়ি বরিশালের হিজলা উপজেলার চরমোনিয়া গ্রামে যাচ্ছিলেন।
নিহতদের স্বজনরা জানান, 'আইরিন তার ছোট্ট শিশুকে নিয়ে গত ১মাস যাবৎ রাজাপুর উপজেলার বলাইবাড়ি নামক গ্রামে বাবার বাড়িতে ছিলো, তার স্বামী রিপন হাওলাদার পেশায় ট্রলার চালক। তার বাড়ি বরিশালের হিজলা এলাকায়। শুক্রবার স্ত্রী আইরিনকে খবর দেয় তার স্বামী রিপন। ১৮ মাসের শিশু কন্যাকে নিয়ে বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়িতে আসতে বলেন।
আইরিন ও নয়নের আরেক ভাই মো. রুবেল বলেন, 'আমার ভগ্নিপতি তার ঘটনার দিন সকালে ছোট ভাগ্নি এবং ভাইকে নিয়ে আমার বোন আইরিন তার শশুর বাড়ি হিজলাতে যাচ্ছিলো। যাওয়ার পথে এই দুর্ঘটনায় ওরা সবাই মৃত্যুবরন করেছে।'
এসএসসি রেজাল্ট দেখে যেতে পারলেন না খুশবো আক্তার:
যাত্রীবাহী বাস বাশার স্মৃতি বাসে দুর্ঘটনায় রাজাপুর উপজেলার নিজামিয়া গ্রামের মাওলানা নজরুল ইসলামের স্ত্রী খাদিজা বেগম (৪৩), নজরুল ইসলামের মেয়ে খুশবো আক্তার (১৭) নিহত হয়েছে। খুশবো আক্তার এ বছর এসএসসি পরিক্ষায় অংশ নিয়ে ফলাফলের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, দেখে যেতে পারলেন না তার পরীক্ষার ফলাফল। দুর্ঘটনায় থেমে যায় তার জীবন প্রদীপ। সাথে ভেস্তে যায় পরিবারের একটি সফল স্বপ্ন।
ঝালকাঠি বিআরটি’এর পরিদর্শক (যান্ত্রিক) অনিমেষ মন্ডল বলেন, ফিটনেসসহ গাড়ির কাগজপত্র ও রুট পারমিট সঠিক আছে। ড্রাইভারের লাইসেন্স আপডেট আছে।
ঝালকাঠি জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মামুন শিবলী জানান, কমিটি তদন্ত কাজ শুরু করেছে। হাসপাতালে আহতদের সাথে কথা বলেছি। গাড়ির ফিটনেসসহ কাগজপত্র ঠিক ছিলা কিনা বা কি কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে তা তদন্ত সম্পন্ন না হলে বলা যাচ্ছেনা।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আফরুজুল হক টুটুল বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে বাস দুর্ঘটনায় নিহত স্বজনদের সাথে ও চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকা আহতদের সাথে যোগাযোগ করলেও এখন পর্যন্ত তারা কেউই মামলা করতে আগ্রহী না হওয়ায় এখন পর্যন্ত কোন মামলা রুজু হয়নি। কেউ মামলা করতে আগ্রহী না হলে পুলিশ বাদি হয়ে মামলা দায়ের করবে।
ঝালকাঠি সিভিল সার্জন ডা. এইচএম জহিরুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনায় আহতরা অধিকাংশ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। আর বাকী ২জন চিকিৎসাধীন রয়েছে।
শনিবার সকাল ১০ টার দিকে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া থেকে বরিশালে যাবার পথে ঝালকাঠি সদর উপজেলার ছত্রকান্দা নামক স্থানে বাশার স্মৃতি পরিবহনের বাসটি নিয়ন্ত্রন হারিয়ে পুকুরে পড়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়। এতে ১৭ যাত্রী নিহত হয় এবং ৩৫ যাত্রী আহত হয়।