প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২ আগস্ট বুধবার রংপুরে আসছেন। সেদিন রংপুর জিলা স্কুল মাঠে আওয়ামী লীগের রংপুর বিভাগীয় জনসভায় বক্তব্য রাখবেন সরকারপ্রধান। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমনকে কেন্দ্র করে প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির হিসেব মিলাতে শুরু করেছে রংপুরের মানুষ। শেখ হাসিনা সর্বশেষ রংপুরে এসেছিলেন ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর। এ সময় তিনি রংপুরের পীরগঞ্জ ও তারাগঞ্জে দুইটি নির্বাচনী জনসভা করেছেন। এরপরে আর তিনি রংপুরে আসেননি।
সাড়ে ৪ বছরের বেশি সময় পর শেখ হাসিনা রংপুরে আসছেন। তিনি দ্বাদশ নির্বাচনের প্রচারণা রংপুর থেকে শুরু করবেন দলীয় সূত্র থেকে এই তথ্য জানা গেছে। তাই রংপুরবাসি শেখ হাসিনাকে বরণ করতে প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। জনসভায় ১০ লাখের বেশি মানুষের সমাগমের প্রস্তুতি নিচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় রংপুর বিভাগের ৫৮টি উপজেলার প্রতিটি উপজেলা থেকে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ হাজার মানুষ আনার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। জনসভা সফল করতে আওয়ামী লীগের বিভাগীয় বর্ধিত সভা করা হয়েছে। ওই সভায় ৪ মন্ত্রীসহ কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী জনসভা করার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করার কথা রয়েছে।
এদিকে বর্তমান সরকারের আমলে রংপুরের যে সব উন্নয়ন হয়েছে এসবও জনগণের নিকট তুলে ধরছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাুসিনার আমলে রংপুর বিভাগ, সিটি করপোরেশন, মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এ বছরের ১৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুর বিভাগীয় সদর দপ্তরের উদ্বোধন করেছেন। এ ছাড়া রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয়, মেরিন একাডেমি, উপজেলাগুলোতে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপন, তিস্তা সড়ক সেতু নির্মাণসহ নানা উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন হয়েছে। এলেঙ্গা-রংপুর ছয়লেন মহাসড়কের কাজ চলমান। পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহের কাজও শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এসব উন্নয়নের ফিরিস্তি জনগণের কাছে তুলে ধরছেন দলের একাধিক নেতা।
দলীয় নেতারা বলছেন, ২০১১ সালের ৮ জানুয়ারি রংপুর জিলা স্কুল মাঠে মহাজোটের এক জনসভায় উন্নয়নের দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই থেকে প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন আর উন্নয়নের মোড়কে একসময়ের ‘মঙ্গাপীড়িত’ রংপুরকে বদলে দিয়েছেন।
২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ের মধ্যদিয়ে বদলে যেতে থাকে রংপুর। এরপর টানা তিনবার সরকারে থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রতিষ্ঠা, রংপুর পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, পীরগঞ্জে মেরিন একাডেমি স্থাপন, আদালতের বহুতল ভবন, সিভিল সার্জনের নতুন ভবন, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, বিভাগীয় সদর দপ্তর, রংপুর শিশু হাসপাতাল ও পুলিশ হাসপাতাল, আধুনিক পুলিশ লাইন্স নির্মাণ করেছেন। বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ও সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য রংপুর এখন উত্তরাঞ্চলের রাজধানী।
উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে ১৭ তলাবিশিষ্ট ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণ, র্যাব-১৩ ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি অবকাঠামো। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিস্তাপাড়ের মানুষের ভাগ্যবদলে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর রংপুর সফরকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন স্থানীয়রা। বিশেষ করে আশায় বুক বাঁধছেন তিস্তাপাড়ের মানুষ।
তিস্তাপাড়ের সাধারণ মানুষ এবং তিস্তা নিয়ে যারা আন্দোলন করে আসছেন, তাদের আশা প্রধানমন্ত্রী রংপুরের জনসভায় বহু আকাক্সিক্ষত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো সুখবর নিশ্চয়ই দেবেন। কারণ, পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় তিস্তা এখন উত্তরের মানুষের দুঃখ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর বন্যা এবং খরায় নদীপাড়ের মানুষের দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। তিস্তার দুই পাড়ের লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করতে পারে একমাত্র মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে তিস্তাপাড়ের মানুষের পানির জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না।
তিস্তার কোলেপিঠে থেকে প্রতি বছর বন্যায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা এবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরুর আকুতি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, আমরা ত্রাণ চাই না। আমাদের নদী খনন করা হোক। বাঁধ দেওয়া হোক। শুনেছি চীনের সঙ্গে সরকার চুক্তি করবে। তিস্তাপাড়ের দুই ধারে খনন, বাঁধ, বড় বড় রাস্তা করবে। শহরের মতো এখানে বিদেশিরা আসবে, পর্যটন স্পট হবে। তিস্তাপাড় হয়ে উঠবে পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির মতো সুন্দর নগরী। আমরা তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ দেখতে চাই। প্রধানমন্ত্রী যেন রংপুরের মহাসমাবেশ থেকে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন, এটাই আমাদের চাওয়া।
তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সফিয়ার রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী রংপুরের পুত্রবধূ। ২০১১ থেকে ২০১২ সালের দিকে যখন ভারতের সঙ্গে পানিচুক্তি হলো না, তখন তিনি তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা জানিয়েছিলেন। আমরা সেই সময় তিস্তাপারের লক্ষাধিক মানুষ প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে বিশাল মিছিল ও সমাবেশ করেছিলাম। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য সেটি এক যুগেও বাস্তবায়ন হয়নি।
তিনি বলেন, রংপুর বিভাগে দরিদ্রতার হার সর্বোচ্চ আর বরাদ্দ সর্বনিম্ন। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে অববাহিকার এক কোটি মানুষ উপকৃত হবে। এতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিস্তাপারের ১৩ থেকে ১৪টি উপজেলা ও ১১টি সংসদীয় আসনের ২৫ থেকে ৩০ লাখ ভোটার প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা আনবে।
নদী আন্দোলনের এই সংগঠক বলেন, তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের কয়েক হাজার নেতাকর্মী ও তিস্তাপাড়ের মানুষ ২ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে উপস্থিত হয়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ঘোষণার দাবি জানাবে। এটা আমাদের প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে রংপুর বদলে যাবে। দারিদ্রতা কমে আসবে। উন্নয়ন আরো বেশি তরাণ্বিত হবে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর আগমন ঘিরে রংপুরে চলছে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ও গণসংযোগ। প্রতিদিন সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে মহাসমাবেশ সফল করতে মিটিং মিছিল করছেন। রংপুর বিভাগের প্রতিটি জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটিগুলোও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সিটি করপোরেশনের থানা কমিটি থেকেও চলছে পাড়া-মহল্লায় গণসংযোগ।
দলীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে প্রধানমন্ত্রীর এই মহাসমাবেশ রংপুরবাসীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং চ্যালেঞ্জের। এই মহাসমাবেশ জনসমুদ্রে পরিণত করেত তারা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছেন। সমাবেশে দলের নেতাদের কার্যক্রমের ওপর দলীয় পদপদবি এবং মনোনয়ন প্রত্যাশি ভাগ্যও নির্ধারণ করছে বলে দাবি তাদের। তবে এবার রংপুরের প্রতিটি আসনে দলীয় প্রার্থী চাইছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এরশাদুল হক রঞ্জু বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা টানা তিনবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে রংপুরকে যেভাবে উন্নয়নের মোড়কে সাজিয়েছেন, তা বিগত সময়ে কোনো সরকার করতে পারেনি। রংপুরে অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছে। এখন মঙ্গাপীড়িত রংপুর বলা হয় না, কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণের মধ্যদিয়ে রংপুর থেকে মঙ্গা দূর করেছেন। মানুষের ভাগ্যবদলের সাথে সাথে রংপুর অঞ্চলের ব্যাপক উন্নয়ন ও পরিবর্তন হয়েছে। আমরা প্রধানমন্ত্রী আগমন ঘিরে বিগত ১৪ বছরের উন্নয়ন তুলে ধরে প্রচারণা চালাচ্ছি। দলের নেতাকর্মীরা ছাড়াও সাধারণ মানুষ প্রধানমন্ত্রীর আগমনে উজ্জ্বীবিত।
এদিকে রংপুর বিভাগে ৩৩টি সংসদীয় আসন রয়েছে। রংপুরে ৬টি সংসদীয় আসন রয়েছেন। এর মধ্যে রংপুর সদর ও গঙ্গাচড়া আসনটি দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় পার্টির দখলে রয়েছে। জোটগত কৌশলের কারণে ওই দুটি আসন জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়া
হয়েছিল। এবার ওই দুটি আসন ছাড় দিতে নারাজ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তাদের দাবি এবার রংপুর সদর ও গঙ্গাচড়া আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দিতে হবে।
মনোনয়ন প্রত্যাশি একাধিক নেতা এবার ওই দুটি আসনে মনোনয়ন চাইবেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। এছাড়াও অন্য ৪টি আসন আওয়ামী লীগের দখলে থাকলেও সেখানে ১০-১২ জন মনোনয়ন প্রত্যাশি রয়েছেন। তারা প্রধানমন্ত্রীর জনসভার দিন নিজ নিজ এলাকা থেকে বিপুল সংখ্যক নেতা কর্মী এনে শোডাউন দিবেন। জনসভাকে সমৃদ্ধ আর বিপুল জনগণের উপস্থিতি নিশ্চিতে রংপুর বিভাগের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মুখিয়ে আছেন। এমনটা আভাস পাওয়া গেছে দলের একাধিক নেতার সাথে কথা বলে।
রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও গঙ্গাচড়া আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশি অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম রাজু বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই রংপুরের উন্নয়নের দায়িত্ব নিয়েছেন। তার আমলে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। উন্নয়নের কারণে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে রংপুরের মানুষ আওয়ামী লীগগকে বিমুখ করবে না বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, গঙ্গাচড়া আসনে নির্বাচনের জন্য তিনি একজন মনোনয়ন প্রত্যাশি। এ লক্ষে তিনি গণসংযোগ করে যাচ্ছেন।
মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মন্ডল বলেন, নেতাকর্মীরা চায় রংপুর সদর আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দেয়া হউক। আমি দীর্ঘদিন ধরে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে গণসংযোগ করে আসছি। আশা করছি দলের পক্ষ থেকে রংপুর সদর আসনের ব্যাপারটি গুরুত্বসহকারে দেখা হবে।