প্রচন্ড খরার কারণে সময় পেরিয়ে গেলেও পানির অভাবে পাট জাগ দিতে না পেরে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার পাট চাষিরা। জমির ধারে ও রাস্তার ওপর কেটে রাখা পাটের স্তুপ রোদে শুকিয়ে খড়ি হয়ে যাচ্ছে। ফলে আবাদের সোনালী আঁশ এখন কৃষকের গলার ফাঁস বা কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
খাল-বিলে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন উপজেলার পাট চাষিরা। বর্ষার ভরা মৌসুমেও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়াসহ খাল-বিলে পানি না ওঠায় চরম বিপাকে পড়েছেন তারা। তাই বাধ্য হয়ে আশপাশের ক্ষুদ্র জলাশয়, ডোবা, পুকুর ও জমির মধ্যে শ্যালো ইঞ্জিন চালিত মেশিনের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করে সেই পানিতে পাট জাগ দিচ্ছেন। এতে বেশি খরচ হচ্ছে এবং পাটের গুণগত মানও কমে যাচ্ছে। পাটের কালো রঙ ধারণ করছে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৪০ হেক্টর জমি। সরকারি সহায়তা ও অনুদান পাওয়ায় উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে তা ৫৫৬ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে।
উপজেলার নশরতপুর, সাতনালা, তেঁতুলিয়া, আলোকডিহি, দেবীগঞ্জ, ডাঙ্গারহাট, ঘন্টাঘর, বিন্যাকুড়ি, সুখীপীর, বেলতলী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পানি না থাকায় কৃষকরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। উপজেলার নদী, পুকুর, খাল-বিল কোথাও পর্যাপ্ত পানি না থাকায় পাট জাগ দিতে পারছেন না তারা। কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে অনেক কৃষক পাট কেটে ক্ষেতেই ফেলে রাখছেন। অনেকেই আকাশের বৃষ্টির আশায় পাট না কেটে রেখে দিচ্ছেন। আবার অনেকেই পর্যাপ্ত পানি না পেয়ে নিচু জায়গায় জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে জাগ দিচ্ছেন। অনেকেই শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি উত্তোলন করে জমিতেই পাট জাগ দিচ্ছেন। পাটের ফলন ভালো হলেও পর্যাপ্ত পানির অভাবে পাটের সোনালী আঁশ আর সোনালী না থেকে ফ্যাকাসে ও কালো রঙ হয়ে যাচ্ছে। এতে পাটের বাজারদর অনেক কম হবে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা।
উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে চাষ করা বেশির ভাগ জমির পাট কাটা শুরু হয়েছে। কেউ কেউ পাটের আঁশ ছড়াচ্ছেন। কেউবা শুকাচ্ছেন পাটকাঠি। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে মাঠে তেমন একটা পানি জমেনি। জমি থেকে নদী বা খালের দূরত্ব বেশি হওয়ায় শ্রমিকদের অতিরিক্ত মজুরি দিতে হচ্ছে। অনেকে অতিরিক্ত টাকা খরচ করে রিকশাভ্যানে করে নিয়ে নদী বা খালে পাট জাগ দিচ্ছেন। তবে এতে খরচ বেশি হওয়ায় অনেকে পাট কেটে মাথায় বা ঘাড়ে করে নিয়ে পাশের খালে বা বাড়ির পুকুরে পাট জাগ দিচ্ছেন।
উপজেলার নশরতপুর ইউনিয়নের কৃষক উজ্জ্বল হোসেন, নুর মোহাম্মদসহ কয়েকজন বলেন, এ বছর বৃষ্টির পরিমাণ খুব কম। পুরো আষাঢ় মাস প্রায় বৃষ্টিহীনভাবে গেল। শ্রাবণ মাসেও বৃষ্টি তেমন একটা নেই। তাই আমাদের এলাকায় এখনও কোথাও পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি নেই। বর্ষা মৌসুমে আকাশের পানির আশায় আছি। যেখানে খালে সামান্য বৃষ্টির পানি জমেছে সেখানেই অনেকেই পাট জাগ দিচ্ছেন। প্রয়োজনীয় পানির অভাবে পাটের আঁশ ছড়ানো নিয়ে অনেকেই দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছেন। এবছর এ পর্যন্ত কাঙ্খিত বৃষ্টি না হওয়ায় নদী-নালা, পুকুর, ডোবায় পানি না থাকায় সনাতন পদ্ধতিতে পাট জাগ দিতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। কৃষকরা আরও জানান, এ বছর রোগবালাই খুব একটা না থাকায় পাটের ফলনও ভালো হয়েছে। আকাশের কাঙ্খিত বৃষ্টি না হওয়ায় পানির অভাবে অনেকেই বাধ্য হয়ে শ্যালো মেশিন ও মোটর দিয়ে ডোবা-নালায় পানি তুলে পাট জাগ দিচ্ছেন। এতে বাড়তি টাকা গুণতে হচ্ছে।
আলোকডিহি ইউনিয়নের রাসডাঙ্গার কৃষক ওবায়দুর রহমান বলেন, এ বছর আমি ৩ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছি। এরমধ্যে ১ বিঘা জমির পাট কেটে রেখেছি, এখনো জাগ দিতে পারিনি। অবশিষ্ট ২ বিঘা জমির পাট এখনো জমিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওই এলাকার আবদুর রহমান, সোলায়মান আলী, রমানাথসহ কয়েকজন কৃষক জানান, গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর পাটের আবাদ ভালো হয়েছে। পাট কেটে জমিতে স্তুপ করে রেখে দিয়েছি। খাল, বিল, পুকুর-ডোবা-নালা আর নিচু জমিতে কোথাও পর্যাপ্ত পানি নেই। তাই পাট জাগ দিতে পারছি না। পাটের স্তুপ প্রখর রোদে মধ্যেই শুকিয়ে যাচ্ছে। আবাদের পাট নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়েছি। অনেক কৃষক সামান্য পানিতে পাটের জাগে কলাগাছ, মাটি ও মাটির বস্তা চাপা দিয়ে কোনো রকমে পাট পঁচানোর চেষ্টা করছেন।
উপজেলা কৃষি অফসার কৃষিবিদ জোহরা সুলতানা বলেন, এ বছর বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় নদী, খাল-বিলে পর্যাপ্ত পানি নেই। তাই কৃষকেরা পাট জাগ দেয়া নিয়ে কিছুটা সমস্যায় পড়েছেন। তিনি আরো বলেন, জমি থেকে অনেক দূরে বহন করে নিয়ে পাট জাগ দিতে হচ্ছে। এতে পাট উৎপাদনে কৃষকের খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক কৃষকই বিকল্প রিবোন রেটিং পদ্ধতিতে পাটের আঁশ সংগ্রহ করছেন। কিন্তু পাটের ন্যায্য বাজার মূল্য পেলে চাষিদের লোকসান গুণতে হবে না।