অব্যাহত নদী ভাঙন ও ড্রেজারের মাধ্যমে বালু উত্তোলনে অচিরেই বিলীন হয়ে যেতে পারে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার হোসেন্দী, গজারিয়া ও ইমামপুর ইউনিয়নের মেঘনা তীরবর্তী গ্রামগুলো।
এনিয়ে হোসেন্দী ইউনিয়নের ইসমানিরচর, গোয়ালগাঁও, গজারিয়া ইউনিয়নের নয়ানগর, চর রমজানবেগ এবং ইমামপুর ইউনিয়নের বড় কালীপুরা, বেরি মোল্লাকান্দি গ্রামের হাজার হাজার পরিবারে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মেঘনা নদী তীরবর্তী মানুষ ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত পার করছেন। চোখের পলকেই নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে মাথাগোঁজার একমাত্র ঠিকানা। কেউ কেউ বাপ-দাদার ভিটে সরিয়ে অন্য জায়গা চলে যাচ্ছেন।
জানা যায়, একদিকে মেঘনা নদীর পানি বৃদ্ধি অপর দিকে শত শত কাটিং ড্রেজার দিয়ে নদী থেকে বালু উত্তোলনে নদী তীরবর্তী ৬টি গ্রাম ভাঙনের কবলে পড়েছে। এতে কমপক্ষে ২০-২৫টির বেশি ঘর অন্য জায়গা সরিয়ে নিতে হয়েছে। অনেকে খোলা জায়গায় বসবাস করছে। অনেকে আবার শেষ সম্বল ঘরবাড়ি, গাছপালা নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে ভাঙন ঠেকাতে বিভিন্ন পয়েন্টে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলানোর কাজ করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড। স্থানীয়রা বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন।
নদী তীরের বাসিন্দা ইসমানিরচর গ্রামের ষাটোর্ধ্ব রুহুল আমিন বলেন, সারাদিন কাজ করে রাতে বিছানায় যাই। ক্লান্ত শরীরে দ্রুত ঘুম আসে। হঠাৎ নদী ভাঙনের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। আতঙ্কিত হয়ে পড়ি এই বুঝি ঘরবাড়ি ভেসে যায়! পরে এই চিন্তায় রাতে আর ঘুম হয় না।
নয়ানগর গ্রামের সাইফুল ইসলাম বলেন, বসতভিটা নদীতে আগেই বিলীন হয়ে গেছে। নিজের সহায় সম্পত্তি বলতে কিছুই আর নেই। বর্তমান তিনি তার নব্বই বছর বয়সী বৃদ্ধা মাকে নিয়ে নদী তীরে অন্যের জমিতে একটি ছাপড়া ঘরে থাকেন। এখন সেই ছাপড়া ঘরও নদীতে বিলীন হওয়ার উপক্রম। এরপর কোথায় হবে একটু মাথাগোঁজার ঠাঁই। সেই চিন্তার ছাপ সাইফুল ইসলাম।
নদী তীরের আরেক বাসিন্দা আমেনা বেগম। স্বামী মারা গেছে ২৫ বছর আগে। স্বামীর রেখে যাওয়া শেষ সম্বল বলতে বাড়ির এই ভিটাটুকুই আছে। কিন্তু যেকোন মুহুর্তে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে মাথাগোঁজার শেষ আশ্রয়স্থল। কান্নাজড়িত কন্ঠে আমেনা বেগম বলেন, সারা রাত ঘুম ধরে না, সব সময় ভয়ে আতঙ্কে থাকি এই বুঝি বাড়ি ভাইঙা পড়ে নদীতে। এবার বুঝি আর বসতভিটায় থাকা হবে না। কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিব, দিশে খুঁজে পাচ্ছি না।
ভাঙন আতঙ্কে অন্যত্র ভিটে সরিয়ে নিয়েছে হোসেন জমাদার। তিনি জানান,শুনেছি এই জায়গা স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হবে। কিন্তু আমাদের আর সেই সুখ কপালে নেই। তার আগেই বাপ-দাদার ভিটা নদীতে বিলীন হয়ে যাবে।
হোসেন্দী ইউনিয়নের হোসেন্দী গ্রামে ইয়াকুব আলী জানান, ভাঙন ঠেকাতে পাউবো জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বিগত বছর গুলোতে মেঘনা নদীতে বালুমহাল ইজারার কারণে নদীর তীরে ব্যাপক ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এতে অনেকের বসত ভিটি ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। অসংখ্য পরিবার একমাত্র সহায় সম্বল হারিয়ে পথে বসেছে। তাই এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মেঘনা নদীর মহালের ইজারা বাতিল করে। কিন্তু হঠাৎ করে একটি প্রভাবশালী চক্র আবারো মেঘনা নদীতে ড্রেজার মেশিনের সাহায্যে বালি উত্তোলন করে কোটি কোটি টাকার বালু বিক্রি করেছে। তাদের ভয়ে তাদের বিরুদ্ধ কথা বলার সাহস পান না। তাদের বিরুদ্ধাচরণ করলেই বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়। এর ফলে নদীর পাড়ে ব্যাপক ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকের বাড়িঘর বিলীন হয়েছে। তারা মনে করেন, উপজেলা প্রশাসন সরেজমিন তদন্ত না করেই প্রভাবশালীদের চাপ কিংবা অর্থের কাছে নতি স্বীকার করেছেন। না হয় গণবিরোধী এমন সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই নিতে পারে না উপজেলা প্রশাসন।
জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ জানান, তাদেরকে নদীর মাঝ থেকে বালু উত্তোলন করতে বলা হয়েছে। নদীর তীরে ড্রেজার মেশিনের সাহায্যে বালু উত্তোলন করলে আমাকে জানালে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।