মেঘনা নদীর মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া অংশে নদী ভাঙ্গন ঝুঁকির কারণ দেখিয়ে দীর্ঘদিন বন্ধ করে রাখা একটি বালুমহাল সম্প্রতি পুনরায় চালু করায় নদী ভাঙ্গন শুরু হয়েছে নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোতে। এতে ভাঙ্গন ঝুঁকিতে পড়েছে কয়েকটি সরকারি স্থাপনা আর ভাঙ্গন আতঙ্কে দিন কাটছে নদী পাড়ের ছয়টি গ্রামের সহ¯্রাধিক পরিবারের। জনস্বার্থে অনতিবিলম্বে বালুমহালটির ইজারা বাতিল করে দিতে বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেছেন একজন ইউপি চেয়ারম্যান।
সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, মেঘনা নদীর গজারিয়া অংশের নির্মাণাধীন ষোলআনী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৬'শো মিটারেরও কম দূরত্বে শতাধিক ড্রেজার দিয়ে নদী থেকে বালু কাটা হচ্ছে। জানা যায়, ২০১৮ সালে জেলা প্রশাসন থেকে এই জায়গাটি বালুমহালের জন্য ইজারা দিতে চাইলে নদী ভাঙ্গনের ঝুঁকি আছে দাবি করে আফসার উদ্দিন ভূঁইয়া নামে এক ব্যক্তি এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। বালুমহালের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী সেই ব্যক্তি এবার এই বালুমহালের ইজারা পেয়েছেন। ২কোটি ৭১ লক্ষ টাকায় তিনি নদীর গজারিয়া অংশের নয়ানগর,ষোলআনী কালীপুরা,রমজানবেগ অংশে ১২৮ একর এলাকায় বালু উত্তোলনের ইজারা পেয়েছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, নদীর ইজারা দেওয়া অংশে বালুর পরিমাণ কম হওয়ায় সন্ধ্যা হলেই ড্রেজারগুলো নদীর তীর ঘেঁষে বালু উত্তোলন করে। এতে ষোলআনী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, কোস্টগার্ডের গজারিয়া ডকইয়ার্ড ও বেইজ স্টেশন, গজারিয়া লঞ্চ ঘাট সহ বেশ কিছু সরকারি স্থাপনা ভাঙ্গন ঝুঁকিতে রয়েছে। নদীর এই ভাঙ্গন প্রবণ এই অংশে বালুমহাল পুনরায় চালু করায় ইসমানীচর, গোয়ালগাও, নয়ানগর, ষোলআনী, বড় কালীপুরা এবং তনু সরকারের কান্দি গ্রামে নদী তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন তীব্রতর হয়েছে।
বিষয়টি সম্পর্কে ইমামপুর ইউনিয়নের বড় কালীপুরা গ্রামের বাসিন্দা সেলিম মিয়া বলেন, এমনিতেই আমাদের গ্রামটি গজারিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভাঙ্গন প্রবণ। প্রতিবছরই নদী ভাঙ্গনের শিকার হতে হয় আমাদের। এবছর বালুমহালের কারণে ভাঙ্গণ আরো বেড়েছে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা ভিটামাটির সরিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন।
বিষয়টি সম্পর্কে স্থানীয় হোসেন্দী ইউনিয়নের ইসমানীচর গ্রামের বাসিন্দা মোরশেদ আলম বলেন, গত প্রায় এক মাস ধরে নতুন করে মেঘনা তীরবর্তী ইসমানীচর গ্রামে নদী ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। ভাঙ্গন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে গ্রামটির অন্তত একশো পরিবার।
ষোলআনী বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়নকারী সংস্থা আরপিসিএলের নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) মোঃ সেলিম ভূঁইয়া জানান, বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অবগত রয়েছি। আমাদের বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য নির্ধারিত জায়গায় খুব কাছেই একটি বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়েছে। আমরা সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখছি।
বিষয়টি সম্পর্কে ইমামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাফিজ্জুজামান খান জিতু বলেন, আপনারা যদি জেলা প্রশাসনের ওয়েব পোর্টাল দেখেন সেখানে এখনো দেওয়া আছে এই জায়গাটি অত্যন্ত নদী ভাঙ্গন প্রবণ হওয়ায় এখানে বালুমহাল ইজারা দেওয়া বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পরে হঠাৎ করে গত কিছুদিন আগে এই বালুমহালটি ইজারা দেওয়ায় সেখান থেকে বালু উত্তোলন শুরু হয়েছে। এতে ভাঙ্গন ঝুঁকিতে পড়েছে ষোলআনী বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প এবং আমার ইউনিয়নের বড় কালীপুরা,তনু সরকার কান্দি গ্রামের কয়েকশো পরিবার। ইজারা বাতিল চেয়ে উপজেলার সকল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান একজোট হয়ে এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের নিকট আবেদন করেছেন তারা।
বিষয়টি সম্পর্কে রিট পিটিশনকারী হোসেন্দী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল হক মিঠু বলেন, বালুমহালটি চালু করার পর থেকে আমার ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামে নদী ভাঙ্গন শুরু হয়ে গেছে। আমরা বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙ্গন প্রতিরোধের চেষ্টা করছি। বিষয়টি আমরা লিখিতভাবে জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছি তারা কোন পদক্ষেপ না নেওয়ায় জনস্বার্থে আমি হাইকোর্টে এ ব্যাপারে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেছি। আমার ধারণা যথাযথভাবে হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে না করে যে স্থান থেকে বালু উত্তোলন করলে নদী ভাঙ্গনের ঝুঁকি রয়েছে সেখানে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বালু মহল ইজারা দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি কে.এম. কামরুল কাদের এবং বিচারপতি মোহাম্মদ সাখাওয়াত আলী চৌধুরীর দ্বৈত বেঞ্চে এ বিষয়ে একাধিকবার শুনানি হলেও এখনো পর্যন্ত কোনো আদেশ হয়নি।
বিষয়টি সম্পর্কে বালুমহাল ইজারাদার আফসার উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, সকল প্রক্রিয়া মেনেই আমরা বালুমহাল চালু করেছি। জেলা প্রশাসনের নির্ধারিত করে দেওয়ার সীমানার বাইরে থেকে আমরা বালু উত্তোলন করছি না তবে এ ব্যাপারে কিছু লোকজন বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। আমার জানামতে নদীর এ অংশে কোথাও কোন নদী ভাঙ্গন হচ্ছে না।
বিষয়টি সম্পর্কে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)এর হাইড্রোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক বেগম শামসুন্নাহারের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসন থেকে প্রায় ত্রিশটির মত জায়গা বালুমহাল ইজারা দেওয়ার জন্য হাইড্রাফিক সার্ভে করে দেওয়ার জন্য আমাদের কাছে পাঠানো হয়। পর্যাপ্ত বালু না থাকায় আমরা অধিকাংশের অনুমতি দেইনি। জেলা প্রশাসনের বিশেষ অনুরোধে হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভের পরে অল্প পরিমাণ বালু আছে এমন ৫/৬টি জায়গা বালুমহাল ইজারা দেওয়া যায় এই মর্মে আমরা প্রতিবেদন দাখিল করেছি। তবে সেখানেও নদী ভাঙ্গন ঝুঁকি রয়েছে নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে থেকে বালু যাতে না কাটা হয় সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি সম্পর্কে গজারিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ বলেন, হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে সংক্রান্ত কোনো কাগজ আমার কাছে নেই। তবে বালুমহাল ইজারাদার যদি নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে থেকে বালু কাটে বিষয়টি আমি জানতে পারলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। আপনারা যে কয়েকটি জায়গায় ভাঙ্গন শুরু হয়েছে অথবা ভাঙ্গন ঝুঁকিতে রয়েছে এমন হিসেবে দাবি করছেন আমরা সেগুলো সরেজমিনে পরিদর্শন করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
বিষয়টি সম্পর্কে মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোঃ আবুজাফর রিপন বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়া মেনেই বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নাই।