উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবন-জীবিকা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিনোদন-সংস্কৃতি, চাওয়া-পাওয়াসহ হাসি-কান্না, মান-অভিমান, আনন্দ-বেদনার সংগ্রামী গল্প তুলে ধরে সাতক্ষীরায় দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হচ্ছে 'ভাটির টানে, বাদার গানে' অনুষ্ঠান। জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে অনুষ্ঠানমালার শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন বাঘ বিধবা সোনাভানু ও আইলাকালীন সময়ে জন্মগ্রহনকারী শিশু বন্যা। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা 'বারসিক' এর আয়োজনে অনুষ্ঠানমালার মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ও সুন্দরবন সুরক্ষায় যুবদের ভূমিকা শীর্ষক বক্তৃতা প্রতিযোগিতা, উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের টিকে থাকার গল্প, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের সমস্যা ও সম্ভাবনার দাবিতে প্লাকার্ড প্রদর্শনী, কৃষি জমি সুরক্ষায় নাগরিক মঞ্চ, আমাদের উপকূলীয় বিভিন্ন পেশাজীবী ও স্থানীয়দের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, দুর্যোগ সচেতনতায় যুবদের আয়োজনে পথনাটক, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি পরিবেশনা ও পুরস্কার বিতরণী। বক্তৃতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় ও সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীরা জলবায়ুর পরিবর্তন প্রতিরোধ ও সুন্দরবন সুরক্ষায় যুবদের ভূমিকা তুলে ধরে বলেন, পৃথিবীতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী মানুষ। পরিবেশ দূষণের ফলেই বৃদ্ধি পাচ্ছে তাপমাত্রা। এর ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর উপর। প্রাকৃতিক দুর্যোগের রক্ষা কবজ সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হলে যুব সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। আগামী প্রজন্মকে সুস্থ সবল রাখতে হলে একটি সুন্দর পৃথিবী সবার কাম্য। তাই আগামীর বাসযোগ্য সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলার লক্ষ্যে যুব সমাজকে একসাথে কাজ করার আহ্বান জানান বক্তারা। অনুষ্ঠানে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের সুখ-দুঃখ হাসি কান্না মান-অভিমানের গল্প তুলে ধরেন বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ। ভাটির টানে, বাদার গানে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দাবি নিয়ে ঘোষণা করা হয় 'উপকূল'। দাবিগুলোর মধ্যে ছিল টেকসই বেড়িবাঁধ চাই, আপনার পরিবেশ আপনার দায়িত্ব, বেঁচে থাকার অধিকার চাই, জলবায়ুর সুবিচার চাই, ত্রাণ চাইনা বাঁচতে চাই, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পরিবেশকে হতে দিব না বিপন্ন, গাছ লাগাই ভবিষ্যৎ বাঁচাই, আমাদের সুন্দরবন আমাদের অক্সিজেন ইত্যাদি। অনুষ্ঠানটি শতশত শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সাংবাদিক, সংস্কৃতি জন, বনজীবী, কৃষক-কৃষাণীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে। অনুষ্ঠানে শ্যামনগর উপজেলা জনসংগঠন সমন্বয় কমিটির সভাপতি, চ্যানেল আই কৃষি পদকপ্রাপ্ত শেখ সিরাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ আব্দ্লু হামিদ, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, মানবাধিকার কর্মী মাধব দত্ত, নাগরিক নেতা আলী নূর খান বাবুল, অধ্যাপক ইদ্রিস আলী, আশরাফ হোসেন, সাংবাদিক আমিনা বিলকিস ময়না, সংস্কৃতিজন হেনরী সরদার, কর্ণ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান, সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক হুমায়ুন কবির, ধুলিহর-ব্রহ্মরাজপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক এসএম শহীদুল ইসলাম, সাংবাদিক রনজিত বর্মন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বারসিক-এর জেলা সমন্বয়কারী মাসুম বিল্লাহ, আঞ্চলিক সসমন্বয়কারী রামকৃষ্ণ জোয়ারদার, বারসিক-এর ধনঞ্জয় মন্ডল, গাজী মাহিদা মিজান প্রমুখ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বারসিক-এর মফিজুর রহমান। অনুষ্ঠানে পরিবেশ ও কৃষি জমি রক্ষায় কৃষি জমি রক্ষায় প্রস্তাবিত আইন ও নীতিমালা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দেশের সকল ধরনের কৃষিজমি রক্ষা ও সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে একটি সুনির্দিষ্ট সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। নিদিষ্ট শিল্পাঞ্চলের বাইরে কৃষি জমির ওপর যত্রতত্র অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধে আইন প্রণয়ন ও তার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কৃষি জমিতে ইট ভাঁটা নির্মাণ, বেচাকেনা সম্পূর্ণরুপে বন্ধ ঘোষণা করতে সরকারের যে কোনো উন্নয়নমূলক কাজের জন্য (রাস্তাঘাট, অবকাঠামো নির্মাণ) কৃষি জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে যাচাই বাছাই করতে হবে। কৃষিজমির যথেচ্ছ ব্যবহার করে অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, দালানকোঠা, বাসভবন নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে (যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা) জলবদ্ধতা দূর করে কৃষি জমি উদ্ধার ও চাষের উপোযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। ড্রেজিং ব্যবহারের মাধ্যমে ছোট বা বড় নদী খননের সময় যে কোনো ধরনের কৃষি জমিতে বালু ফেলা নিষিদ্ধ করতে হবে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট প্রভৃতি এলাকায় কৃষি জমিতে প্রবেশকৃত পানির লবণাক্ততা কমিয়ে বোরো ধান চাষের উপযোগী করতে হবে। কৃষি জমির ক্ষয় রোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং জনগণকে সতর্ক ও সচেতন করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষি জমির সক্ষমতা ধরে রাখার জন্য কৃষককে এবং সাধারণ জনগণকে সচেতন করতে হবে। কৃষি জমিতে কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। ক্ষতিকারক অননুমোদিত কীটনাশক বিক্রেতাদের শাস্তির আওতায় আনতে আনাসহ ৮৯টি দাবি সম্বলিত প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হয়। দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানকে ঘিরে সাতক্ষীরা শিল্পকলা একাডেমি চত্ত্বরে স্থানীয় উপকূলীয় মানুষের জীবন-জীবিকার সাথে মিশে থাকা নানা পণ্যের সমন্বয়ে দেওয়া হয় স্টল। স্টলে শোভা পায় মাটির তৈরি তৈজসপত্র, বাঁশ ও বেতের তৈরি গৃহস্থালির সামগ্রী, পরিবেশ বান্ধব বন্ধু চুলা, সুন্দরবনের গোলফল, গোলপাতা, মধু, মোম, বাঁশি, জাল, খারাসহ নানা জিনিস। এ ছাড়া স্থানীয় জাতের ১৫০ প্রজাতির ধানবীজ প্রদর্শনী করেন কৃষক আবদুল বারিক। এ ছাড়া তেলাকুচা, শাপলা, সজিনা, হেলেঞ্চা, মালঞ্চ, কচুফুল, ডুমুর, তিতবেগুন, ব্রাহ্মী, কলার মোচাসহ স্থানীয় কুড়িয়ে পাওয়া সবজির সমারোহ দর্শকদের মন কাড়ে এ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানে নৃত্যের তালে, গানের সুরে ও নাটকের অভিনয়ে ফুটে ওঠে উপকূলীয় মানুষের জীবন সংগ্রামের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। শিশু কিশোর যুব বৃদ্ধসহ সকল শ্রেণির মানুষ উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে হৃদয়হরা এ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠান শেষে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি উপকূল কমিটি ঘোষণা করা হয়।