অ্যালেন গিন্সবার্গের সেই বিখ্যাত কবিতার যশোর রোড ‘বিশ্বখ্যাত’ হলেও নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানেন না এর ইতিহাস ঐতিহ্য। যশোর শহর থেকে কোলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত সড়কটির ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানানোর কোন উদ্যোগ গ্রহন করা হয়নি আজও।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত সড়কটি এখন যশোর-বেনাপোল রোড নামেই পরিচিত।
অথচ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার খবর বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল এই ‘যশোর রোড’র সূত্র ধরে। পাকিস্তানী সেনাদের বর্বর হত্যাযজ্ঞের সময় প্রাণ বাঁচাতে নিরস্ত্র লক্ষ লক্ষ নারী পুরুষ যশোর রোড দিয়ে পালিয়ে ছিল ভারতে। পালানো দৃশ্যচিত্র বিশ্ববাসীকে নাড়িয়ে দেয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন কোলকাতায় এসে মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের।যশোর সীমান্ত ও আশপাশের শরণার্থী ক্যাম্প ঘুরে তিনি কবিতাটি লেখেন। পরে আমেরিকায় ফিরে গিয়ে তার বন্ধু বিখ্যাত সংগীত শিল্পী ‘বব ডিলান’ ও অন্য গায়কদের সহায়তায় শরণার্থীদের জন্য অর্থও সংগ্রহ করেছিলেন। ৭১’র ভয়াল দিনগুলোয় বাঙালির দুঃখ-দুর্শশার দৃশ্যপট কবিতাটির মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। কবিতার ও গানের কলিতে ‘যশোর রোড’ সারা বিশ্ব হয়ে ওঠে পরিচিত। স্থান করে নেয় ঐতিহাসিক মর্যাদা-আলাপচারিতায় এমনটাই বলেছেন ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেন যশোরের এমন মানুষেরা। অনেক প্রবীণ ব্যক্তিদেরও এমনই মতামত।
সম্প্রতি সড়কটি ঘুরলে দেখা যায়, সরকারি বেসরকারি কিংবা ব্যক্তিগত কোন উদ্যোগ এখনও নেওয়া হয়নি সড়কটির যশোর রোড নামকরণের। সড়কটির বাংলাদেশ অংশের কোথাও এটির নাম ‘যশোর রোড’ সেটি লেখা নেই। সড়কের পাশে সরকারি কোন প্রতিষ্ঠানেও যশোরে রোডের নাম লেখা নেই। সড়কের দুই পাশ জুড়ে অগণিত দোকানপাট, হোটেল রেস্তোরাসহ অন্যসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাইন বোর্ডেও ‘যশোর রোড’ এই নামটি কোথাও লেখা নেই।
যশোরের ইতিহাসবিদ ও ঔপন্যাসিক হোসেনউদ্দীন হোসেনের মতে, বাংলাদেশ আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বুক চিরে চলে গেছে এই ঐতিহাসিক সড়ক। যার শুরু বাংলাদেশের যশোর জেলা থেকে, যা বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত বেনাপোল-পেট্রাপোল পেরিয়ে সোজা কোলকাতায় গিয়ে মিশেছে। সেই যশোর রোড নিয়ে কত কাহিনী, কত ইতিহাস এখনো ঘুরে বেড়ায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই যশোর রোড হয়ে উঠেছিল এক জীবন্ত ইতিহাস। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক আর্মির বর্বরতা শুরু হলে নিরস্ত্র বাঙালি সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যাবার প্রধান পথ হয়ে ওঠে যশোর রোড। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি মানুষের ভারতে আশ্রয়ে যাবার প্রধান পথ হয়ে ওঠে এ রোড। এই রোডের পাশে কত মুক্তিযোদ্ধা আর শরণার্থী শিবির গড়ে উঠেছিল। এই রোড ঘুরেছেন অনেক নেতা, কবি-সাহিত্যিকেরা।
প্রথমে যশোর থেকে কলকাতায় যাওয়ার বিকল্প মাধ্যম ছিল নৌপথ। তখন যশোরে গড়ে ওঠা উচ্চ ও মধ্য শ্রেণির প্রায় সবাই ছিলেন হিন্দু। হিন্দুদের কাছে গঙ্গাস্নান পুণ্যের কাজ। সেই সময় যশোর থেকে বহু হিন্দু নারী গঙ্গাস্নানের জন্য নদীপথে কলকাতা যেতেন।
সে সময় যশোর শহরের বকচরের জমিদার ছিলেন কালী প্রসাদ পোদ্দার। কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে তার ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। নৌকার মাঝিদের অসহযোগিতার কারণে একবার জমিদারের মা যশোদা গঙ্গাস্নানে যেতে না পারায় নিজেকে অপমানিত বোধ করে ঘরের দরজা বন্ধ করে অনশনে বসেন। গঙ্গাস্নানের জন্য যশোর থেকে চাকদা পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করে দিলেই তিনি অনশন প্রত্যাহার করবেন। পুত্র কালী প্রসাদ মায়ের দাবি মেনে রাস্তা নির্মাণ করেন। ফলে এই রাস্তাকে অনেকে কালী বাবুর সড়ক বলেও অভিহিত করেন। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সড়কটি পুনরায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বৃষ্টি আর কাদাপানি উপেক্ষা করে সেদিন লাখ লাখ মানুষ এই পথ ধরেই অজানার উদ্দেশে ঘর ছেড়েছিলেন। পেছনে যুদ্ধ ও মৃত্যু এবং সম্মুখে অসীম অনিশ্চয়তার মাঝে নিজ দেশ ছেড়ে এসব মানুষ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমিয়েছিলেন। যশোর থেকে নদীয়ার গঙ্গাঘাট পর্যন্ত ৮০ কি. মি. সড়কের ১৬৮ বছর আগে রোপিত প্রবীণ শিশু গাছগুলো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কালী পোদ্দারের সেই যশোর রোড আজ নেই, বাংলাদেশ অংশে যা আছে তা যশোর-বেনাপোল সড়ক। কালীগঞ্জ হয়ে বেনাপোল পর্যন্ত এই রাস্তার দু’ধারে শত শত সাইনবোর্ডে আজ লেখা রয়েছে ‘বেনাপোল রোড’। কিন্তু বেনাপোল সীমান্ত পেরুলেই ভারতের পেট্রাপোল থেকে শুরু করে কলকাতার গঙ্গা তীরের কালীঘাট মন্দির পর্যন্ত রাস্তাটি আজও ‘যশোর রোড’ নামে ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে আছে।
ঝিকরগাছার স্থানীয় সাংবাদিক নজরুল ইসলাম বলেন, সড়কটির ইতিহাস সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সরকারের কাছে আহ্বান জানাই, ইতিহাস সমৃদ্ধ সড়কটির প্রবেশদ্বারে একটি ‘যশোর রোড’ নামে যশোর গেট বা যশোর রোড নামসম্বলিত কোন ফলক নির্মাণের।
ঝিকরগাছা মহিলা কলেজের উপাধ্যক্ষ মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন বলেন, যশোর রোড ইতিহাসের সাক্ষী। বহন করছে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ঐতিহ্য। কালের সাক্ষী সড়কটি ও এর পাশে থাকা বিশাল আকৃতি রেইনট্রি (বৃষ্টি শিরীষ) গাছগুলো রক্ষণাবেক্ষণ দরকার।
মুক্তিযুদ্ধকালীন বৃহত্তর যশোরের মুজিব বাহিনীর উপপ্রধান অ্যাডভোকেট রবিউল আলম বলেন, ২৫ মার্চের পর থেকে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি আর্মিরা যশোর শহরে অবস্থান নিতে থাকে। এরপর থেকে শুরু হয় তাদের হত্যাযজ্ঞ। রাস্তার ধারের পথচারী ও ঘুমন্ত অতি সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করতে থাকে। ৭১’র এমন দিনগুলোয় যশোর রোড দিয়ে মানুষজন ভারত ছুটতে থাকেন। অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্য দিয়ে তারা এই পথ দিয়ে ভারত গমণ করেন। তিনি বলেন, ‘খুলনার ডাক বাংলো রোড থেকে নওয়াপাড়া কয়লা ঘাট পর্যন্ত সড়কটিকে ‘যশোর রোড’ বলেন খুলনার মানুষ। কিন্তু যশোরের রোডটির এই নাম ব্যবহার করেন না। তিনি মনে করেন, ‘সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত খুলনা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত সড়কটির নাম হবে যশোর রোড। আইন করে হলেও রোডের সাইনবোর্ড, দলিল দস্তাবেজসহ ট্রেড লাইলেন্সে এই রোডের নাম ‘যশোর রোড’ ব্যবহার করার নিয়ম জারি করতে হবে। তাহলে মুক্তিযুদ্ধের এই স্মারক সড়কটি সম্পর্কে আগামীর ভব্যিষৎ প্রজন্ম জানতে পারবে।
যশোরের ইতিহাস গবেষক ও সাংবাদিক সাজেদ রহমান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু মার্কিন কবি ও সাংবাদিক অ্যালেন গিন্সবার্গ ভারতের শরণার্থী শিবিরে বাঙালিদের দুর্বিষহ জীবনকে প্রত্যক্ষ করেন। লাখো লাখো দুর্দশাপীড়িত মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট দেখে আবেগাপ্লত হয়ে প্রতিবাদী কবি লিখেছিলেন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামে এক অনন্য কবিতা। মুক্তিযুদ্ধে যশোর রোড ঐতিহাসিক হলেও এর স্মৃতি রক্ষার্থে এখানে তেমন কোন কিছুই করা হয়নি।