‘আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও, রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও। বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি। একটু খানি বৃষ্টি হলে গড়িয়ে পড়ে পানি। একটু খানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে, তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে’। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে পল্লীকবি জসিম উদ্দিনের আসমানী রুপে ধরা দিয়েছেন রংপুরের পীরগাছার জগৎপুর গ্রামের সত্তোর্ধ বৃদ্ধা হামিদা বেগম। জীবন থেকে ৭৬ বছর পেরিয়ে গেলেও তার কপালে আজোও জোটেনি স্থায়ী একটি মাথা গোঁজার ঠাই। অন্যের জমিতে মানুষের সাহায্য-সহযোগিতায় ১০ হাত একটি টিনের চালা দিতে পারলেও তার বেড়া এখনো পর্যন্ত দিতে পারেনি। নিজের ও ছেলের বউয়ের পড়নের পুরাতন কাপড় দিয়ে ঘেরা দিয়েছেন সেই চাল। একটু বৃষ্টি হলে সেই ঘরের মধ্যে ঢুকছে পানি। আর এভাবেই চলছে ছেলের বউ ও দুই নাতীকে নিয়ে বৃদ্ধা হামিদা বেগমের জীবন।
ভিটেমাটিহীন হামিদা বেগম থাকেন পীরগাছার পারুল ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ২০০ গজ উত্তরে প্রতিবেশী নাতী আনারুল ইসলামের বাড়ির এক কোনায়। সংসার জীবনে একমাত্র সন্তান আবদুল হামিদ, ছেলে বউ মনোয়ারা বেগম, দুই নাতী শামীম ও সাকিবকে নিয়ে তার সংসার। ছেলেকে বিয়ে দিয়ে সুখে থাকার আশাও ব্যথিত করেছে হামিদা বেগমকে। বৃদ্ধ বয়সে শরীর আর চলছে না তার। স্বামীর গ্রামের মায়ায় পড়ে আজো তিনি বাস্তু-ভিটাহীন। শুধুমাত্র বিধবা ভাতা ছাড়া তার কপালে জোটেনি আর কোন সরকারি সুযোগ-সুবিধা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিবেশি ভ্যানচালক আনারুল ইসলামের বসত ভিটার এক কোনায় ছোট্ট ১০ হাত টিনের চাল। তাতে নেই বেড়া, নেই দরজা। পড়নের কাপড়-চোপড় দিয়ে ঘেরা ঘরটিতে রয়েছে ছোট একটি খাট। একটি ভাঙ্গা-চারা টেবিলে রাখা কয়েকটি পাতিল। সেখানে থাকছেন ওই বউ শ্বাশুড়ি।
ছেলে আবদুল হামিদের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম বলেন, আমার স্বামী অর্ধপাগল। সে বাড়িতে থাকে না। আমি অসুস্থ শ্বাশুড়ী, ছেলে শামীম (৮) ও সাকিল মিয়াকে (৬) নিয়ে এই ঘরে এক খাটেই গাদাগাদি করে রাত পার করছি। বৃষ্টি-বাতাস হলে বৃষ্টির পানি ঢুকে বিছানা ভিজে যায়। তখন সারারাত বসে থেকে রাত কাটাতে হয় আমাদের। আয়-রোজগারের লোক নাই। আমি মানুষের বাসায় কাজ করে যা পাই তা দিয়ে খেয়ে-না খেয়ে কোনমতে দিন পার করছি। কখনো কাজ না থাকলে উপোস থাকতে হয়। আশেপাশের মানুষ মাঝে মধ্যে আমাদেরকে খাবার দেন। আমাদেরকে স্থায়ী একটি থাকার ঘরের ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য আমি সরকারসহ বিত্তবানদের সাহায্য কামনা করছি।
বৃদ্ধা হামিদা বেগম বলেন, আমার একহাত প্যারালাইসিস এ আক্রান্ত হয়ে অচল। কোন কাজকর্ম করতে পারি না। কয়েক মাস অন্তর শুধু বিধবা ভাতার টাকা পাই। তা দিয়ে তো ৪ জনের সংসার চলে না। তাই আমি বিত্তবানদের সাহায্যে কামনা করছি।
স্থানীয় বাসিন্দা হারুন মিয়া, তুহিন মিয়া বলেন, আমরা জন্মের পর থেকেই তাদের দেখছি। কোন জমিজমা নেই। অন্যের জমিতে জীবন পার করছেন। তিনি এলাকার মায়ায় পড়ে কোথাও যেতে চান না। বর্তমান যুগেও তাদের যে করুণ দশা, তা খুবই দুঃখজনক। আমরা চাই তার একটি ঘরের ব্যবস্থা হোক।
ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নুরুল আমিন বলেন, ওই পরিবারটিকে আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘরে যাবার জন্য কয়েক বার বলা হলেও তিনি যেতে চান না। আর ঈদের সময় তাকে ভিজিএফ চাল দেয়া হয়। পারুল ইউপি চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন বলেন, আমি অসুস্থ। কেউ এ বিষয়ে আমাকে জানায়নি। এখন দেখি কোন ব্যবস্থা করা যায় নাকি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নাজমুল হক সুমন বলেন, বিষয়টি জানার পর উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) মুসা নাসের চৌধুরী, প্রকল্প বায়স্তবায়ন কর্মকর্তা আবদুল আজিজ ওই বৃদ্ধার বাড়িতে গিয়েছেন। তাকে আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর দেওয়ার কথা জানানো হলেও তিনি সেখানে যেতে রাজি হননি। আয়-রোজগার ও দেখভালের লোক না থাকায় তিনি যাবেন না। তাৎক্ষনিক ভাবে তাকে খাদ্য সহায়তা এবং নগদ অর্থ প্রদান করা হয়েছে।