সংসারে অভাব-অনটনের কারণে মাত্র ১২ বছর বয়সে বাবার হাত ধরে মুচির পেশায় আসেন মঙ্গল রবি দাস। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে দীর্ঘ ৩৫ বছরের কর্মজীবনে নিজের অবস্থানে আমূল পরিবর্তন এনেছেন। চামড়া থেকে তৈরি বাহারি রকমের পণ্য তৈরি করে মাসে লাখ টাকা আয় করছেন। মুচি বা রবি দাস সম্প্রদায়ের লোকজন বলছেন, ‘কঠোর পরিশ্রমের কারণেই মঙ্গল আজ জিরো থেকে হিরো হয়েছেন’। মঙ্গলের বাড়ি শেরপুর সদর উপজেলার লছমনপুর ইউনিয়নের জামতালা গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের মৃত. শ্রীনাথ রবি দাসের ছেলে। তিনি বর্তমানে জেলা শহরের অষ্টমীতলা এলাকার টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ড এলাকায় একটি ভাড়া দোকানে জুতা সেলাই, তৈরি এবং মেরামতের কাজ করে আসছেন। মঙ্গল রবি দাস জানান- সাত ভাই, দুই বোন আর মা-বাবা নিয়ে ছিল তাদের সংসার। ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ৬ষ্ঠ। বাবা শ্রীনাথ পেশায় মুচির কাজ করতেন। সারাদিন স্থানীয় কুসুমহাটি বাজারে সড়কের পাশে বসে গ্রাহকদের জুতা সেলাইয়ের কাজ করতেন। প্রতিদিন আয় হতো ৩০-৪০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু ওই আয়ে তার বাবার পক্ষে ১১ জনের সংসার চালানো ভীষণ কষ্ট হতো। এ কারণে বছরজুড়ে সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকতো। তাই আয় বাড়াতে জুতা, তৈরি ও সেলাইয়ের কাজ শেখানোর জন্য বাবা তাকে সঙ্গে রাখতে শুরু করেন। তখন তার বয়স ১২ বছর। ঐ বয়সেই জুতা তৈরির অন্যতম উপকরণ গাড়ির পরিত্যক্ত টায়ার কাটার কাজ শেখেন। এরপর ধীরে ধীরে বাবা তাকে শিখিয়ে দেন কাঠ ও টায়ারের সমন্বয়ে জুতা তৈরির কৌশল। গ্রাম্য ভাষায় যা খড়মের জুতা নামে পরিচিত। তখন থেকে দিনে দুই জোড়া খড়মের জুতা তৈরি করা শুরু করেন। আর প্রতি জোড়া জুতা বাজারে বিক্রি করতেন ৮ টাকা দরে- জানান মঙ্গল রবি দাস। তিনি আরো জানান, এভাবে বেশ কিছু দিন কাজ করার পর একসময় ভাবেন সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে জুতার ডিজাইনে পরিবর্তন আনা জরুরি। গ্রাহকের চাহিদা পুরণ করতে এবং জুতায় নতুনত্ব আনতে আরো কাজ শিখতে চলে যান পাশের জেলা জামালপুরে। সেখানে এক বোন জামাইয়ের জুতার কারখানায় দীর্ঘদিন শ্রমিকের কাজ করেন। এরপর নিজ জেলায় ফিরে বাজিতখিলা গ্রামে এক মামাতো ভাইয়ের জুতার দোকানে থেকে আরো কিছু কাজ শেখেন। পরে চিন্তা করেন এবার নিজেই নতুন জুতা তৈরি এবং মেরামতের দোকান দেবেন। ওই অবস্থায় তার হাতে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ না থাকায় চিন্তিত হয়ে পড়েন। মঙ্গল রবি দাস বলেন, ওই সময়ে আত্মীয়-স্বজনদের কাছে অর্থিক সহায়তা চেয়ে নিরাশ হই। কোনো উপায় না পেয়ে ১৯৮৮ সালে পৈত্রিক জমি বিক্রি করে ২৬ হাজার ৫০০ টাকা সিকিউরিটি মানি আর মাসিক ৩০০ টাকা ভাড়ায় জেলা শহরের অষ্টমীতলা এলাকায় দোকান নেই। সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে শুরু হয় নতুন পথ চলা। প্রথমদিকে শুধু জুতা মেরামতের কাজ করা হতো। কাজের মান ভালো হওয়ায় ধীরে ধীরে গ্রাহকের আনাগোনো বাড়তে থাকে। এরপর টায়ার কেটে নানা ডিজাইনের সেন্ডেল জুতা তৈরি করা শুরু করি। একপর্যায়ে ব্যবসা আরো জমজমাট হয়ে উঠে। মঙ্গল রবি দাস জানান, বর্তমানে তার কারখানায় তৈরি হচ্ছে সু, স্যান্ডেল, চটিসহ বিভিন্ন ডিজাইনের লেডিস এবং জেন্টস সামগ্রী। গড়ে প্রতিদিন ১০-১৫ জোড়া নতুন জুতা তৈরির অর্ডার পাওয়া যায়। আর দুই ঈদ, দুর্গাপূজা এবং অন্যান্য উৎসবে জুতার চাহিদা বেড়ে ২-৩ গুণ হয়। ওইসব জুতা ২০০-১৮০০ টাকার মধ্যে ডেলিভারি দেওয়া হয়।তিনি আরো জানান, জুতা সেলাই, তৈরি ও মেরামতের কাজ করে প্রতি মাসে অন্তত দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত আমদানি হয়। আয়ের ৩০ লাখ টাকায় এ পর্যন্ত ১০০ শতাংশ জমি ও বাড়ি করেছেন। শহরের চকপাঠক এলাকার নারায়ন রবি দাস বলেন, ‘মঙ্গল ছোটবেলা থেকে জুতার কাজ করছে। এ কারণে সবধরনের জুতা তৈরির কলা-কৌশল সহজেই সে শিখেছে। আমার মত আরো অনেকেই তার কাছে কাজ শিখতে যায়। সে অনেক পরিশ্রম করেই জিরো থেকে আজ হিরো হয়েছেন’। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের জেলা শাখার ব্যবস্থাপক বিজয় কুমার দত্ত বলেন, জুতা তৈরিতে মঙ্গল রবি দাসের আরো উন্নত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হলে তাকে সহযোগিতা করা হবে।