মানব পাচার চক্রের খপ্পরে পড়ে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার এক তরুনসহ ১৭ যুবক গত চার মাস ধরে লিবিয়ায় সন্ত্রাসীদের আস্তানায় জিম্মি অবস্থায় দিনাপিতপাত করছে। ভুমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি পৌছে দেয়ার প্রতিশ্রুতিতে মাথাপিছু ১১ থেকে ১৩ লাখ টাকা আদায় করেও স্থানীয়দের সহায়তায় লিবিয়ায় নিয়ে তাদের জিম্মি করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে জিম্মি অবস্থায় থাকা এসব তরুন ও যুবকদের মুটোফোনে পরিবারের সাথে যোগাযোগের সুযোগ দিয়ে বাড়ি থেকে মুক্তিপনের অর্থ পাঠানোর জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া একই চক্রের অপর একটি চালানের হয়ে ইতালি রওনা যাওয়ার প্রাক্কালে গত ১০ সেপ্টেম্বর লিবিয় পুলিশের হাতে আটক হয়ে সেখানকার কারাগারে রয়েছে আরও তিনজন তরুন। সালামিন, আসমত ও শাহাজান নামের ঐ তিনজন যথাক্রমে শ্যামনগর উপজেলার নকিপুর, মানিকখালী এবং কালিঞ্চি গ্রামের আবু জাফর, নুর আমিন ও জাকির আলীর ছেলে। এসব তরুনদের পরিবারের দাবি প্রায় সাত মাস আগে তিন দফায় ১৩ লাখ টাকা নিয়ে তাদেরকে ইতালি পৌছে দেয়ার শর্তে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্তানেরা এখন কারাগারে অর্ধাহারে অনাহারে কাটাচ্ছে জানিয়ে তাদের উদ্ধারে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন অভিভাবকরা। ভুক্তোভোগী পরিবার, স্থানীয় একাধিক সুত্রসহ স্বয়ং মানবপাচার চক্রের কয়েক সদস্যের সাথে কথা বলে এসব চিত্র ফুটে উঠেছে।
জানা যায় শ্যামনগর উপজেলার শ্রীফলকাঠি গ্রামের হারুন-অর রশিদ, তার ভগ্নিপতি মনিরুল ইসলাম এবং ধুমঘাট গ্রামের সেকেন্দ মিলে সংঘবদ্ধ এ মানব পাচারচক্র গড়ে তুলেছে। স্থানীয়ভাবে সেকেন্দারসহ কয়েকজন নিকটাত্বীয়কে দায়িত্ব দিয়ে হারুন ঢাকা ও মনিরুল এবং মুরাদ লিবিয়ায় অবস্থান করে সিন্ডিকেট পরিচালনা করছে। আরও জানা যায় শুরুতে আট থেকে নয় লাখ টাকায় সাগর পথে ইতালি পৌছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ‘শিকার’কে লিবিয়ায় নিয়ে যায়। পরবর্তীতে ভাল নৌযানে তুলে দেয়াসহ নানার অজুহাতে আর দুই থেকে তিন লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তারা।
ভুক্তোভোগী পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা গেছে শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী গ্রামের দেলোয়ার কয়াল, মামুন কয়াল, তারানীপুরের আবু রায়হান, বংশীপুরের মিলন, কৈখালীর আনারুল মিস্ত্রি, রহিম সরদার, মিঠু কয়াল, পুর্ব কৈখালীর জামির আলী জাম, আবদুল কাদের ও রাসেল হোসেন পাচার চক্রের হাতে এই মুহুর্তে জিম্মি। তবে পাচার চক্রের নিকটাত্বীয় হওয়ার সুবাদে রমি, হাসান, বায়েজিদসহ অফর একজনকে আস্তানায় রেখে দেয়া হলেও কোন ধরনের নির্ডাতন করা হচ্ছে না।
মামুন কয়ালের পিতা জাহার আলী কয়াল জানান প্রায় একমাস আগে অন্যান্যের সাথে মিলে তার ছেলের একটি ভিডিও পরিবারের কাছে পাঠানো হয়। সামনে দাঁড়িয়ে ধারণকৃত সে ভিডিওতে বাড়ি থেকে টাকা পাঠানোর জন্য কাকুতি মিনতি করতে দেখা যায় তাদের। তিনি আরও জানান ঐ ভিডিও এলাকায় প্রচার হয়ে পড়লে পাচারচক্রের সদস্যরা বেকায়দায় পড়ে জিম্মি ঐ যুবকদের দিয়ে নুতন একটি ভিডিও তৈরী করে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে চোখেমুখে আতঙ্ক নিয়ে মামুনসহ অন্যান্যের বলতে দেখা যায় ‘সাংবাদিক ভাইয়েরা কোন নিউজ করবেন না, আমরা ভাল আছি”। তবে মামুন ও তার এক সহযোগীর মাথায় রিভলবর ঠেকিয়ে গত সোমবার নুতন করে পাঠানো ভিডিওতে আবারও মামুনসহ অন্যদেরকে টাকা চাইতে দেখা যায়।
ভুক্তোভোগী পরিবারগুলোর অভিযোগ নির্বিঘেœ ইতালি পৌছে দেয়ার অঙ্গীকার করে হারুন ও সেকেন্দার তাদের নিকট থেকে টাকা নিযে যায়। পরবর্তীতে ছেলেকে পাঠানো হলেও দীর্ঘ সাত মাসেও তাদের ইতালীতে পৌছাতে পারেনি।
সালামিন হোসেনের পিতা আবু জাফর জানান জমি বন্ধকের তিন লাখসহ মাজাট গ্রামের নুরমোহাম্মদ ও প্রভাষ কর্মকারের নিকট থেকে চড়াসুদে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে তিনি সর্বসাকুল্যে ৮ লাখ টাকা দিয়েছিল। অথচ ইতালি ঢুকতে পারা দুরের কথা তার ছেলে গত এক মাসেরও বেশী সময় ধরে লিবিয় কারাগারে মানবেতন জীবনযাপন করছে।
অপর কারাবন্দী শাহাজানের পিতা নুর আমিন জানায় শেষ সম্বল চাষের জমি বিক্রি করে হারুনের ‘টোপে’ পড়ে ছেলেকে ইতালি পাঠানোর চেষ্টা করেছিলেন। কারাবন্দী হওয়ার পর থেকে তাকে ছাড়ানোর অজুহাতে হারুনের লোকজন বার বার এক লাখ দেড় লাখ টাকা দাবি করছে। সকালে ও সন্ধ্যায় শুধুমাত্র দু’টি খেতে দেয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন গত কিছুদিন ধরে হারুন আর মোবাইল রিসিভ করছে না।
হারুন-মনিরল-সেকেন্দার সিন্ডিকেটের হাতে অপর জিম্মি আবদুল কাদেরের ভাই আবদুর রাজ্জাক জানান জমি বিক্রি করে আট লাখ টাকায় ভাইকে ইতালি পাঠিয়েছিলেন। তবে পাচারকারীরা তাদেরকে লিবিয়ায় নিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় রেখে দফায় দফায় আরও তিন/চার লাখ টাকা আদায় করেছে। তিনি অভিযোগ করেন প্রায় এক মাস আগে একবার সাগর পাড়ি দেয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে ্রপতিমাসে বাড়ি থেকে পাঠানো টাকা দিলেও কেবল তার খাওয়ার জুটছে। চরম অমানবিক অবস্থায় দিনাতিপাত করছে দাবি করে ভঅইকে উদ্ধারে তিনি বৈদেশিক ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হস্তক্পে কামনা করেন।
প্রধান অভিযুক্ত হারুন-অর রশিদ জানান কিছু মানুষকে গত মাসে নৌকায় তুলে দিলেও মাল্টা সাগর উত্তাল থাকায় তারা ফিরে আসে। যাদের মধ্যে কারাগারে থাকা তার তিনজনসহ মুরাদের ১৭ জনকে মুক্ত করার চেষ্টা চলছে। নিজেরা কাউকে জিম্মি করেনি - দাবি করে পাচার চক্রের এ হোতা আরও জানান তার ভগ্নিপতি মনিরুলেল আস্তানা থেকে পালিয়ে যাওয়া কয়েকজন লিবিয় সন্ত্রাসীদের হাতে আটক হওয়ায় তারা মুক্তিপন চাইছে। সেখানকার সহযোগীদের সহায়তায় জিম্মিদশা থেকে সেসব যুবকদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে বলেও তিনি দাবি করেন।