চলতি বছর দেশব্যাপী এ পর্যন্ত ১১টি হালকা ও মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। সর্বশেষ সোমবার ঢাকাসহ সারা দেশে ৫ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। ছোটখাটো ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের আভাস দেয়। ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানেই রয়েছে ঢাকার নাম। ভূ-স্তরে ইউরেশিয়ান প্লেটের অবস্থান বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটার দূরে। এই প্লেটটির পাশেই ভারত-বার্মা প্লেট। সাম্প্রতিক সময়ে প্লেট দুটি অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠায় কয়েকদিন পর পরই হচ্ছে মৃদু ভূমিকম্প। সাম্প্রতিক ভূকম্পনগুলো মৃদু মাত্রার হলেও এগুলো বড় বিপর্যয়ের পূর্বাভাস। দেশে ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ঢাকা। এক প্রতিবেদনে দেখা যায় ভূমিকম্পে ঢাকা মেট্রোপলিটনের এক শতাংশ ভবনও যদি ধ্বংস হয় তাহলে ৬,০০০ ভবন বিধ্বস্ত হবে। যার ফলে অন্তত তিন লাখ মানুষ সরাসরি হতাহত হবে। আর অপরিকল্পিতভাবে তৈরি শহরে ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার ও সেবার কাজ পরিচালনা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় আরো বহু মানুষের জীবন ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। রাজধানীতে ভূমিকম্পে এত বেশি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার প্রধান কারণ হলো অপরিকল্পিত নগরায়ন ও ভবন নির্মাণ। বাংলাদেশেও বাণিজ্যিক বা আবাসিক ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অনিয়ম বা দুর্নীতির অভিযোগ নতুন কোনো বিষয় নয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলেই ভবন তৈরির ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নানা ধরণের অনিয়মের অভিযোগ উঠে থাকে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এক গবেষণায় দেখা যায় বাংলাদেশে ভবন তৈরির ক্ষেত্রে জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করা, ভবনের নকশা অনুমোদন ও বাস্তবায়ন বা অঞ্চল পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ না নেয়ার মত নানা অনিয়মের কারণে বেশীরভাগ ভবনই খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। গত ফেব্রুয়ারিতে তুরস্ক ও সিরিয়া সীমান্তে সংঘটিত ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও প্রাণহানি ঘটে। তুরস্ক-সিরীয় সীমান্তবর্তী শহর গাজিয়ানতেপ থেকে সৃষ্টি এই ভূমিকম্পে তুরস্কের ১০টি প্রদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। তুরস্ক সেনাবাহিনীর দক্ষ প্রশিক্ষণ, উন্নত লজিস্টিক সাপোর্ট সত্ত্বেও শুরুতে সেখানে এক মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয়। আমাদের দেশে এ ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানলে কি পরিস্থিতি দাঁড়াবে তা কল্পনাতীত। ভূমিকম্প এমন এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যাকে প্রতিরোধ করার কোনো উপায় মানুষের আয়ত্তে নেই। এমনকি এর পূর্বাভাস দেয়াও সম্ভব হয় না। তাই ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রাখার পূর্বপ্রস্তুতিই আসল। যেহেতু অপরিকল্পিতভাবে শহর গড়ে উঠেছে এবং তা পরিবর্তনেরও সুযোগ নেই, তাই ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম যাতে করা যায়, এখন সেদিকে বেশি মনোযোগ দেয়া জরুরি। যেসব এলাকা ধসের শিকার হবে, সেসব এলাকায় যাতে সড়ক কিংবা অন্যকোনো পথে উদ্ধারকারীরা দ্রুত সরঞ্জামাদি নিয়ে পৌঁছতে পারে, এ পরিকল্পনা করতে হবে। ভূমিকম্প টের পেলে মানুষজন যাতে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিতে পার, এমন স্থান তৈরি করতে হবে। ভূমিকম্প সম্পর্কে নাগরিক সচেতনতা তৈরি করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো ভূমিকম্পের কোনো আগাম পূর্বাভাস পাওয়া যায় না। তাই জনগণকে সম্পৃক্ত করে জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সীমিত সম্পদ ও ক্ষমতার আওতার মধ্যেই এ দুর্যোগ মোকাবিলার ত্বরিত প্রস্তুতি নেয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।