ঘনিয়ে আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়। এ নির্বাচনকে ঘিরে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচার-প্রচারণা শুরু না হলেও দিনাজপুর-৪ (চিরিরবন্দর-খানসাসা) আসনে বইছে আগাম নির্বাচনী হাওয়া। পাড়া-মহল্লায় তৈরি হয়েছে নির্বাচনী আমেজ। ভোটারদের মন জয় করতে নানা প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনী এলাকায় ব্যানার, ফেষ্টুন ও বিলবোর্ড লাগিয়ে দোয় প্রার্থী হয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। দলীয় মনোনয়ন পেতে কেন্দ্রে দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছেন অনেক প্রার্থীই। সরকারের ধারাবাহিক উন্নয়ন কর্মকান্ড তুলে ধরে ও নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার তুলে ধরে ভোটারদের দ্বারস্থ হচ্ছেন প্রার্থীরা।
দিনাজপুর-৪ (চিরিরবন্দর-খানসামা) আসনটি বেশির ভাগ সময়ই আওয়ামী লীগের দখলে ছিল। কেন্দ্রে সিদ্ধান্তের দিকে তাঁকিয়ে আছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি'র প্রার্থীরা। নির্বাচন নাকি সরকার বিরোধী আন্দোলন ? এমন প্রশ্নে ঘুরপাক খাচ্ছে নিজেদের মধ্যে। এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়নকে কেন্দ্র করে এ আসনে ব্যাপক দলাদলি ও গ্রুপিং চলছে। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা তৃণমূল নেতাদের সমর্থন পেতে নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। একে অপরের বিষেদাগারও করছেন কেউ কেউ। সকলেই মনোনয়ন নিশ্চিত পাবেন, এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করে প্রচারণা চালাচ্ছেন। তবে এ আসনে দলীয় সুবিধাবাদি নেতারা বর্তমান সংসদ সদস্যের বিরোধিতা করলেও তৃণমূলের সাধারণ নৌকার ভোটারগণ তার প্রতি বেশ দুর্বল। তৃণমুল ভোটারদের কথা হচ্ছে, বর্তমান এমপি শান্তিপ্রিয়, উন্নয়নকামি মানুষ। তিনি হিংসাত্মক বা উগ্র নন। তিনি কখনও কারো বিরুদ্ধে প্রতিশোধ পরায়ন নন। তাঁর যোগ্যতারও সুনাম করছেন সকলেই। তবে তিনি নিজের ভালটা ভাল বুঝেন। তৃণমুল ভোটারদের দাবি তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে মনোনয়ন দিলে সুবিধাবাদি নেতারা সুবিধা পাবে, আওয়ামীলীগের ঐক্যবদ্ধতা নষ্ট হবে। এলাকার উন্নয়ন কম হবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বর্তমান সংসদ সদস্য, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবুল হাসান মাহমুদ আলী এমপি আওয়ামী লীগের একজন সম্ভাব্য প্রার্থী। নির্বাচনী এলাকায় তিনি বড় বড় মেগা প্রকল্পের যেমন কাঁকড়া সেতু, আত্রাই সেতু, হাসপাতাল, রাস্তা প্রশস্তকরণ, মডেল মসজিদের বরাদ্দকরণ, ফায়ার সার্ভিস, পল্লী বিদ্যুতের সাব স্টেশন, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সহ ব্যাপক উন্নয়ন করায় সাধারণ মানুষ ও নৌকার তৃণমুল ভক্তরা তাঁর পক্ষে সোচ্চার।
তবে এ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের চিফ কনসালট্যান্ট ও প্রখ্যাত চিকিৎসক স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডাঃ এম আমজাদ হোসেনও মনোনয়ন পেতে দীর্ঘদিন যাবত কেন্দ্রে ব্যাপক লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন। কেন্দ্রে তাঁর ব্যাপক লবিং থাকলেও এলাকায় আওয়ামীলীগ বা সর্বসাধারণের মাঝে তেমন সাড়া বা আগ্রহ নাই। তাঁর জনপ্রিয়তা শুন্যের কোঠায়। আওয়ামীলীগের নেতারা তেমন তাঁর সাথে নাই। তারপরও তিনি আশায় আশায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত আমেনা বাকী স্কুলের কয়েকজন কর্মকর্তাকে নিয়ে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এছাড়াও সাবেক এমপি ও হুইপ আলহাজ্ব মিজানুর রহমান মানু এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি কেন্দ্রিয় কৃষকলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছিলেন। তিনি বর্তমানে মনোনয়ন প্রাপ্তির লক্ষ্যে পুরো নির্বাচনী এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। তাঁর কিছু পুরনো খুঁটি ও ভক্ত নেতাকর্মী রয়েছে। তৃণমুল নেতাকর্মীদের তার প্রতি কদর বেড়েছে। তিনি এলাকায় আসলে অনেক পদস্থ নেতাকর্মী তাঁর সাথে দেখা করে তার সাথে থাকার মনোভাব ব্যক্ত করছেন।
আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকায় আরও রয়েছেন-চিরিরবন্দর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ তারিকুল ইসলাম তারিক। তিনি উপজেলা আওয়ামীলীগের দীর্ঘদিনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক থাকায় তার কিছু ভক্ত নেতা কর্মী রয়েছে। তিনিও বেশ জোরালোভাবে প্রচারণা ও গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকার বিপক্ষে স্বতন্ত্র নির্বাচন করায় আওয়ামীলীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাকর্মীরা তাঁর প্রতি অনেকটা ক্ষুদ্ধ। বর্তমান সংসদ সদস্য এখন পর্যন্ত ওই কারনে তাঁকে মেনে নেননি। এছাড়াও প্রশাসনের এক কর্মকর্তাকে মারধর করায় প্রশাসনও তার উপর বিরুপ ধারনা নিয়ে আছে।
এছাড়াও দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানব সম্পদ বিষয়ক সম্পাদক, দিনাজপুর সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি ও সাবেক ছাত্রনেতা শেখ রফিকুল ইসলাম, চিরিরবন্দর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি জ্যোতিষ চন্দ্র রায়, সাবেক জেলা আইনজীবি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মোঃ সাইফুল ইসলাম, দিনাজপুর জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ আনোয়ার হোসেন, চিরিরবন্দর উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ন সম্পাদক মোঃ মোস্তাফিজার রহমান ফিজার মনোনয়নের জন্য প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ প্রকাশ্যে বিলবোর্ড লাগালেও বর্তমান সংসদ সদস্যের সম্মানার্থে চিরিরবন্দর উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও খোচনা এসসি স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ, দিনাজপুর জেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোঃ আহসানুল হক মুকুল, খানসামা উপজেলা চেয়ারম্যান ও খানসামা উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক সফিউল আযম চৌধুরী লায়ন, দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং স্পেশাল জজ আদালতের স্পেশাল পি পি মোঃ শামসুর রহমান পারভেজ, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমোটোলজি বিভাগের ডাঃ সালাউদ্দিন শাহসহ অনেকেই বিলবোর্ড লাগাননি। তাঁরা জানান, বর্তমান সংসদ সদস্য নির্বাচন না করলে তাঁরা প্রকাশ্যেই নেমে পড়বেন। তাঁরা জানান বর্তমান সংসদ সদস্য পছন্দ করুক আর না করুক, তিনি মনোনয়ন পেলে এবং ডাকলেই তাঁর পক্ষেই কাজ করবেন।
অন্যদিকে ঘরোয়াভাবে অনেকটা গোপনে চলছে বিএনপি'র প্রচার-প্রচারণা। অত্র আসনে বর্তমানে রয়েছে বিএনপির শক্তিশালী অবস্থান। এই শক্তিশালী অবস্থান বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মোঃ আখতারুজ্জামান মিয়া কেন্দ্রীক। বর্তমানে দিনাজপুর জেলার মধ্যে এ আসনটিকে বিএনপির ভোটব্যাংক হিসেবে গণ্য করা হয়। দ্রব্যমুল্যের উর্দ্ধগতির কারনে বিএনপির অবস্থান আরো শক্তিশালী হয়েছে। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে কেন্দ্রিয় বিএনপি'র অন্যতম সদস্য, জেলা বিএনপি'র সদস্য ও সাবেক এমপি আলহাজ্ব আখতারুজ্জামান মিয়াই অন্যতম। তাঁর বিকল্প এ আসনে বিএনপির অন্য কারো ভাল অবস্থান নাই। এছাড়াও মনোনয়ন প্রত্যাশী রয়েছেন দিনাজপুর জেলা বিএনপি'র সহ-সভাপতি ও লুসাকা গ্রুপের চেয়ারম্যান শিল্পপতি আলহাজ্ব হাফিজুর রহমান সরকার, চিরিরবন্দর উপজেলা বিএনপি'র সাবেক সভাপতি ও সাবেক এমপি অ্যাড. আব্দুল হালিম। তাদের অবস্থান খুব নাজুক।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও নীরবে মাঠে প্রচারণায় রয়েছেন। তারা ইতিমধ্যে পুলিং এজেন্ট গোপনে ঠিক করে ফেলেছেন। এ আসনে জামায়াত নিরব ভূমিকায় থাকলেও বিএনপি জোটের হয়ে মনোনয়ন চাইতে পারেন জামায়াতের রংপুর অঞ্চল টিম সদস্য ও সাবেক চিরিরবন্দর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব আফতাবউদ্দিন মোল্লা।
অপরদিকে এককভাবে নির্বাচন করলে জাতীয় পার্টির (জাপা) মনোনয়ন প্রত্যাশী খানসামা উপজেলা জাপার আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক মোনাজাত উদ্দিন চৌধুরী মিলন ও সদস্য সচিব মোঃ আব্দুল আলীম হাওলাদার এবং চিরিরবন্দর জাতীয় পিিটর সাধারণ সম্পাদক সাবেক ইউপি সদস্য মোঃ নুরল আমিন মনোনয়ন চাইবেন।
এদিকে স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ এবং ১৯৭৯ সালে দিনাজপুর-৪ আসনে জয়লাভ করেন আওয়ামী লীগের প্রয়াত অ্যাড. শাহ মাহাতাব আহমেদ। ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের হয়ে জয়লাভ করেন সাবেক হুইপ আলহাজ্ব মিজানুর রহমান মানু। ১৯৮৮ সালে জয়লাভ করেন জাপা নেতা প্রয়াত সাখাওয়াত হোসেন। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের তিন বারের এমপি সাবেক হুইপ আলহাজ্ব মোঃ মিজানুর রহমান মানুকে হারিয়ে জয়লাভ করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি'র আলহাজ্ব আখতারুজ্জামান মিয়া। আবার ২০০৮ সালে আখতারুজ্জামান মিয়াকে পরাজিত করে জয়লাভ করেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি পুনরায় নির্বাচিত হন। মিজানুর রহমান মানু ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে আওয়ামীলীগ থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে টিভি প্রতিক নিয়ে নির্বাচন করে পরাজিত হন।
তৃণমুল আওয়ামীলীগের নেতা কর্মীরা জানান, বিএনপি জামায়াতকে তারা বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দিবেনা। অপরদিকে বিএনপির নেতৃবৃন্দও জানান, যদি তত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে সুষ্ঠু ভোট হয়, তারাও আওয়ামীলীগকে বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দিবেনা। সাধারণ মানুষ জানান, যদি বিএনপি ও জামায়াত আলাদা নির্বাচন করে এবং আওয়ামীলীগ যদি দ্বন্দ্ব, ভেদাভেদ রাগ-অনুরাগ ক্ষোভ, বিদ্বেষ ভূলে এক প্রার্থীর হয়ে কাজ করে, তাহলে আওয়ামীলীগের নৌকা বিজয়ী হবে। অপরপক্ষে যদি আওয়ামীলীগে একাধিক প্রার্থী হয়, সেক্ষেত্রে বিএনপি বিজয়ী হবে।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে সাধারণ, তরুণ ও নবীন ভোটাররা জানান-স্মার্ট দেশে স্মার্ট নেতৃত্বই প্রয়োজন। যিনি দূর্নীতি, অনিয়ম, মাদক ও সকল ধরণের বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে আগামীদিনে উন্নয়নের নেতৃত্ব দেবেন এবং এলাকার উন্নয়নে কাজ করবেন এবং যার দ্বারা বড় বড় মেগা প্রকল্প করা সম্ভব এমন প্রার্থীকেই তারা ভোট দেবেন।