কেউ কেউ প্রমিত বাংলা ভাষাকে আমাদের ভাষা বলে মানতে চান না। তাদের যুক্তি এখন যে প্রমিত বাংলা ভাষা এটি একশ বছর আগে ভগিরথীর তীরে গড়ে উঠেছিলো। যার কারণে এটা আমাদের ভাষা হতে পারে না। তারা মনে করেন বাংলাদেশে বাংলা ভাষার একটা নিজস্ব রূপ তৈরি করা দরকার। এটা করতে গিয়ে তারা নানা রকম উদ্যোগ নেন। যার মধ্যে একটা হচ্ছে আঞ্চলিক ভাষা। কোনো না কোনো অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে একটা গদ্যরীতি দাঁড় করানোর চেষ্টা তারা করেন। আবার সাধু-চলতির মিশ্রণ ঘটিয়ে একটা ভাষা দাঁড় করানো কিংবা খুব আটপৌরে মুখের কথার সঙ্গে কিছু হিন্দি কিছু ইংরেজি শব্দ মিশিয়ে তারা একটা ভাষা তৈরি করতে চান। অনেকে বলতে চান যে, এটিই হচ্ছে আমাদের তরুণদের স্বাভাবিক ভাষা। কাজেই এটি ব্যবহার করবো না কেন? অনেক তরুণ মনে করছেন, যেহেতু বেতার ও টেলিভিশনে এই ভাষার একটি রূপ দেখা যায় এটিই বোধ হয় তাদের ব্যবহার্য ভাষা হওয়া উচিত। ফলে আমাদের যে প্রমিত বাংলা ভাষা তার থেকে আমরা অনেক দূর সরে যাচ্ছি এবং ভাষার মধ্যে এক ধরনের বিকার এসেছে। এটাতে অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এটা ঠিক, ভাষা কখনো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না, স্বাভাবিক নিয়মে বিবর্তিত হয়। কিন্তু এফএম রেডিও, বিভিন্ন টেলিভিশন সিরিয়ালে বা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যেটা ঘটছে, সেটা ঠিক স্বাভাবিক বিবর্তন নয়। এটা বর্তমানে প্রমিত বাংলা ভাষাকে অস্বীকার করে তার থেকে যত দূরে যাওয়া যায় তার একটা চেষ্টা। এটা একেকজনের লেখায় তার নিজস্ব ধরন হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে কিন্তু ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে যাওয়া সঙ্গত হবে না। অর্থাৎ এই খিচুড়ি ধরনের ভাষা প্রমিত ভাষার জায়গা নিতে পারবে না। নেওয়া উচিত হবে না।
আঞ্চলিক ভাষার মূল্য আছে, তার একটা নিজস্ব ক্ষেত্র আছে। কিন্তু প্রমিত ভাষারও আবশ্যকতা আছে, তারও একটা ক্ষেত্র আছে। আজকে যারা বলছেন, প্রমিত বাংলা ভাষা আমাদের নয়, তারা আগামীকালই বলবেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম বা প্রমথ চৌধুরীরা যে ভাষায় লিখেছেন সে ভাষা আমরা গ্রহণ করবো না। এর ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তারা খুব নির্মমভাবে ভাগ করতে চাইবেন, যেটা পাকিস্তানিরা চেষ্টা করেও পারেনি। আমাদের অনেকে হয়তো আধুনিকতা ও জনসম্পৃক্তির দোহাই দিয়ে সেটা সম্ভবপর করে তুলতে পারেন। এটা হলে আমাদের জন্য খুব দুঃখের কারণ হবে। আমাদের বুঝতে হবে, প্রমিত ভাষার আবশ্যকতা এবং ভূমিকাটা কী? এটা সকলে যদি বুঝতে পারেন তবে কাজ হবে।
অনেকে মনে করেন যে বাংলা একাডেমি ভাষার বিকৃতি রোধে একটা ভূমিকা নিতে পারে। বাংলা একাডেমীর ঐ জাতীয় কোনো ভূমিকা নেই, তবে বলতে পারে কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে কাউকে কিছু করতে বাধ্য করতে পারে না। বস্তুত ভাষার ক্ষেত্রে কেউই একজনকে বাধ্য করতে পারে না। সব ভাষা একটা সামাজিক চুক্তির মতো, সবাই মিলে যেটা মনে করবে সেটাই ব্যবহার হবে।
ভাষা বিকৃত করার প্রবণতা যদি চলতেই থাকে তাহলে আমরা ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত হয়ে যাবো। দেখা যাবে আমাদের মধ্যেই নানা খ- খ- মত দেখা দিচ্ছে। যেমন সিলেটের অনেকেই মনে করেন যে তাদের মাতৃভাষা বাংলা নয় সিলেটি।
বিশেষ করে যদি লন্ডনে যান তাহলে দেখবেন তীব্রভাবেই তাদের মতের প্রকাশ ঘটছে। সিলেটি, চট্টগ্রামী এই করে প্রমিত বাংলাভাষার বদলে আঞ্চলিক ভাষাগুলো দাঁড়াবে। বাংলাভাষার কর্তৃত্ব আমরা মানতে চাইবো না, এইরকম একটা খারাপ পরিণতি হবে। যেমন বাংলা একাডেমি একটা বানান রীতি করেছে কিন্তু অনেকে সেই বানান রীতি মানছেন না। না মানার একটা কারণ হচ্ছে যে তারা অনেকটা জানেন না বা তারা মানতে চাইছেন না। কলকাতাতেও আমরা দেখবো যে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমীর যে বানান, আনন্দবাজারের যে বানান, সাহিত্য সংসদের যে বানান তার মধ্যেও ভিন্নতা আছে। আমরা একটা চেষ্টা করছিলাম যে বাংলা টেক্সট বুক বোর্ড এবং বাংলা একাডেমি মিলে একই ধরনের বানান ব্যবহারের চেষ্টা করেছিলাম। সেটা সম্পূর্ণ সফল হয়েছে একথা বলা যাবে না। তবে খবরের কাগজগুলোর সহযোগিতা পেলে এটা সম্ভব।
বেতার-টেলিভিশনে আটপৌরে মুখের কথার সঙ্গে কিছু হিন্দি কিছু ইংরেজি শব্দ মিশিয়ে খিচুড়ি ধরনের যে ভাষা এটা প্রমিত ভাষার জায়গা নিতে পারবে না। এই খিচুড়ি ভাষার জায়গা করে দিতে গিয়ে আমাদের যে প্রমিত বাংলা ভাষা তার থেকে অনেক দূর সরে যাচ্ছি এবং ভাষার মধ্যে এক ধরনের বিকার এসেছে। আমাদের উচিত হবে সচেতনভাবেই এটা পরিহার করা।