চলতি বছর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ দেশি কোনো প্রতিষ্ঠান, বিশেষজ্ঞ কারও কোনো পরামর্শই মানা হয়নি। ফলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বলে অভিযোগ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এ ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সুশাসনের ঘাটতিসহ আরও কিছু কারণকে দায়ী করেছে সংস্থাটি। সোমবার রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ - টিআইবির নিজস্ব কার্যালয়ে ‘ডেঙ্গু সংকট প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। চলতি বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ে গবেষণা করে টিআইবি। রাজধানীসহ ১০টি জেলার ওপরে করা গবেষণাটি সংস্থাটির গবেষক রাজিয়া সুলতানা ও জুলকারনাইন উপস্থাপন করেন। সংবাদ সম্মেলনে সুনির্দিষ্ট কৌশলবিহীন ও বিচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম কার্যকর না হওয়া, মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সুশাসনের ঘাটতি ও ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগের পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকাসহ আরও বেশ কিছু কারণও উল্লেখ করেছে তারা। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন দুই লাখ ৬৭ হাজার ৬৮০ জন। একই সময়ে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এক হাজার ৩৩৩ জন। গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম, যথা এডিস মশা প্রতিরোধ পরিকল্পনা ও কৌশল প্রণয়ন, এডিস মশার জরিপ, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিতকরণ, মশা নিধনে জনবল ও উপকরণ, সরকারি ক্রয় ও সরবরাহ, কীটনাশকের মান ও কার্যকারিতা পরীক্ষা এবং মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সমন্বয়-বিষয়ক কার্যক্রমসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া এর আওতায় ডেঙ্গু চিকিৎসা ব্যবস্থা, যথা, রোগ-নির্ণয় (সরকারি ও বেসরকারি), চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম (সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল), চিকিৎসা সামগ্রী ক্রয় ও সরবরাহ ও চিকিৎসা সামগ্রীর বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণের বিষয়হসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গবেষণার ফলাফল পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ধারাবাহিকভাবে বছরব্যাপী বিদ্যমান থাকলেও এ রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিকভাবে পর্যাপ্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়নি। আইন অনুযায়ী, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ড ও আন্তর্জাতিক চর্চা অনুসরণ না করে এবং বাংলাদেশের কোভিড সংকট মোকাবিলার অভিজ্ঞতাকে কাজে না লাগিয়ে সমন্বয়হীনভাবে ডেঙ্গু প্রতিরোধ এবং মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের বিভিন্ন পর্যায়ে সুশাসনের ঘাটতি অব্যাহত রয়েছে। সুনির্দিষ্ট কৌশলবিহীন ও বিচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম কার্যকর না হওয়া এবং ডেঙ্গুর প্রকোপ সারা দেশব্যাপি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া ও বছরজুড়ে অব্যাহত থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সুশাসনের ঘাটতি। ঢাকার বাইরে এডিস মশা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ এবং ডেঙ্গু রোগের পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকা এবছর আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যা ব্যাপক আকার ধারণের অন্যতম কারণ। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে- প্রতি বছর ১০০টি দেশে প্রায় ৪০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে ২০১৭ সাল থেকে ডেঙ্গুর ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ২০২৩ সালে এর ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৬১ হাজার এবং মৃত্যুর সংখ্যা ১ হাজার ২৯৫ জন। যদিও বিশেষজ্ঞ মতে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা সরকার প্রদত্ত সংখ্যার চেয়ে ১০ গুণ বেশি। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ব্রাজিল ব্যতীত অন্য দেশের প্রায় সমপর্যায়ের হলেও মৃত্যুর সংখ্যা ও মৃত্যুর হারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। তারপরও রাজনৈতিকভাবে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এমনকি দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা অস্বীকার করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দায়ভার জনগণের ওপর চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, কীটনাশক ক্রয়ে ওপেন টেন্ডারিং ও সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হলেও ইজিপির মাধ্যমে ওপেন টেন্ডারিংয়ের কিছু ক্ষেত্রে ‘সিঙ্গেল বিডিং’ লক্ষ করা গেছে; একটি কীটনাশক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওপেন টেন্ডারিংয়ের মাধ্যমে তিনটি সিটি কর্পোরেশনের ১৬টি ক্রয়াদেশ পায়, যার মধ্যে সাতটিতে তারা একক বিডার ছিল। কীটনাশক ক্রয়ের ক্ষেত্রে কিছু প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য লক্ষ করা যায় এবং এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিম্নমানের কীটনাশক সরবরাহের অভিযোগ রয়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে আমদানি করা নিবন্ধনবিহীন কীটনাশক যথাযথভাবে পরীক্ষা না করেই মশা নিধন কার্যক্রমে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমরা করোনার ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে ডেঙ্গু প্রকোপ বেড়ে গেলে গবেষণা করে সরকারকে কিছু পরামর্শ দিয়েছিলাম। আশা ছিল নিতিকাঠামো ও নৈতিক ব্যাবস্থাপনায় ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কিন্তু দেখা গেছে এবছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি দেশি ও বৈশ্বিক উভয় মাপকাঠিতেই উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে গেছে। ডেঙ্গু সংকট মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা ও দেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সুনির্দিষ্টভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা অস্বীকার করা এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান করা হয়েছে। তিনি বলেন, দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ধারাবাহিকভাবে সারা বছরব্যাপী বিদ্যমান থাকলেও এই রোগ প্রতিরোধে রাজনৈতিকভাবে পর্যাপ্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়নি; আইন অনুযায়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড ও আন্তর্জাতিক চর্চা অনুসরণ না করা এবং বাংলাদেশের করোনা সংকট মোকাবিলার অভিজ্ঞতাকে কাজে না লাগিয়ে সমন্বয়হীনভাবে ডেঙ্গু প্রতিরোধ এবং মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে।