মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলাধীন মেঘনা দিয়ে চলাচলকারী নৌযান থেকে ব্যবসায়ীদের মালামাল চুরি করতে গড়ে উঠেছে সক্সঘবদ্ধ কয়েকটি নৌ ডাকাত চক্র। পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার ঝাউচর গ্রামের বাসিন্দা হাজী ইকবাল ও শাহ আলীর নেতৃত্বে পরিচালিত এসব চক্রের সদস্যরা অস্ত্রের মুখে নৌযান শ্রমিকদের জিম্মি করে মূল্যবান মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এসব ঘটনায় আতঙ্ক বাড়ছে ব্যবসায়ীদের।
খবর নিয়ে জানা যায়, গজারিয়ার তেতৈতলা পুরাতন ফেরিঘাট এলাকায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)এর বন্দর ও পরিবহন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি শুল্ক আদায় পয়েন্ট রয়েছে। মেঘনা নদীতে চলাচলকারী অনেক নৌযান এই শুল্ক আদায় পয়েন্ট দিয়ে মালামাল উঠানো নামানোর কাজ করে। অন্যদিকে নদীর এই অংশে বিভিন্ন কোম্পানির তেল, চিনি, আটা, ময়দা, সুজিসহ বিভিন্ন ভোগ্য পণ্য উৎপাদনের কারখানা রয়েছে। এসব কারখানা থেকে ভোগ্যপন্য সংগ্রহ করতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা নদীপথে ছুটে আসেন এখানে। সম্প্রতি নদীর এই অংশ থেকে আশঙ্কাজনক হারে পণ্যবাহী নৌযান চুরির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্ক বিরাজ করছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। গেলো অক্টোবর মাসে এরকম দুইটি ঘটনা ঘটে যেখানে নৌযান শ্রমিকদের জিম্মি করে প্রায় আড়াই কোটি টাকার মালামাল চুরি করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে সক্সঘবদ্ধ নৌ ডাকাত দল। স্থানীয়দের তৎপরতায় তারা দুই বার সফল না হলেও সাম্প্রতিক তাদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্কিত এক খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই।
বিভিন্ন সূত্রের খবর, সক্সঘবদ্ধ এই নৌ ডাকাত চক্রের নেপথ্যে রয়েছে সোনারগাঁও উপজেলার ঝাউচর গ্রামের আলাউদ্দিনের ছেলে হাজী মোহাম্মদ ইকবাল। গজারিয়া উপজেলার বড় রায়পাড়া এলাকায় তার মালিকানায় একটি ডকইয়ার্ড রয়েছে। ডকইয়ার্ড ব্যবসার আড়ালে নদী থেকে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের মালামাল চুরি করাই তার প্রধান কাজ। আড়ালে থেকে তিনি চক্রের কোন সদস্য আটক হলে তাকে ছাড়িয়ে আনেন,পুলিশি ঝামেলা সহ সবকিছু তদারকি করেন। সূত্রের খবর চক্রের দ্বিতীয় স্তরে কাজ করে হাজী ইকবালের বন্ধু শাহ আলী এবং এবং মোহাম্মদ আলী। চক্রের তৃতীয় স্তরে রয়েছে হাবিব উল্লাহ, রফিকসহ আরও কয়েকজন। তাদের কাজ মালামাল ভর্তি নৌযানের খবর পৌঁছে দেওয়া এবং মালামাল চুরির কাজে সহযোগিতা করা। তারা খবর পৌঁছে দেওয়ার পর হাজী ইকবাল এবং শাহ আলী দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ডাকাত ভাড়া করে আনে। ভাড়াটে ডাকাতরা কিভাবে ডাকাতি করবে তা ঠিক করে দেয় শাহ আলী।
ভুক্তভোগী ট্রলার মালিক হযরত আলী ফকির বলেন, মেঘনাঘাট এলাকার ফ্রেস সহ বিভিন্ন কোম্পানি থেকে তারা মালামাল সংগ্রহ করে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেন। একেক বারের চালানে তারা দেড় থেকে দুই কোটি টাকার টাকার মালামাল নেন। সম্প্রতি দেড় কোটি টাকার মালামাল সহ তার ট্রলারটি ডাকাতি করে নিয়ে যাবার সময় জেলেরা আটক করে। এই ঘটনার পর থেকে নিরাপত্তার শঙ্কায় তিনি এ এলাকায় আসা কমিয়ে দিয়েছেন।
ভুক্তভোগী মাদারীপুর জেলার বাসিন্দা আবদুল মান্নান বলেন, আগে আমরা এখান থেকে নিয়মিত মালামাল নিতে আসতাম নিরাপত্তার কোন ইস্যু ছিল না। সম্প্রতি একের পর এক চুরির ঘটনায় আমাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। নৌপথে পণ্য পরিবহনে খরচ কম হওয়ায় দোকান মালিকরা সাশ্রয়ের জন্য এ পথে পণ্য পরিবহন করতেন। চুরির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় তারা এখন সড়কপথে পণ্য পরিবহন করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা মাজহারুল ইসলাম বলেন,তেতৈতলা পুরাতন ফেরিঘাট এলাকাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি সক্সঘবদ্ধ ডাকাত চক্র গড়ে উঠেছে। তাদের কাজ নদী দিয়ে চলাচলকারী মালবাহী নৌযান থেকে মালামাল চুরি করা। এ চক্রের অনেক এজেন্ট রয়েছে যারা বিভিন্ন ধাপে উপরের মহলে খবর পৌঁছে দেয়। আর সেই খবরের ভিত্তিতে চক্রের অন্য সদস্যেরা নির্ধারিত সময়ে অবস্থা বুঝে নৌযানে ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
স্থানীয় বাসিন্দা রবি বেগম বলেন, গত সেপ্টেম্বর মাসে মোহাম্মদ আলী ও হাবিব উল্লাহ তার বাসায় একটি ঘর ভাড়া নেয়। মালামালসহ ট্রলার চুরি করে ট্রলারের শ্রমিকদের জিম্মি করে নিয়ে এসে তার বাড়িতে আটকে রাখে। প্রথমে তিনি বিষয়টি বুঝতে পারেননি, পরে পুলিশের কাজ কাছে সকল ঘটনা শুনে তিনি অবাক হয়েছেন।
এদিকে নদী থেকে মালামালসহ ট্রলার চুরি করতে গিয়ে আটক হওয়া ডাকাত দলের ছয় সদস্যের একজনের সাথে কথা হলে তিনি জানান, তারা কেউ এই এলাকা চিনেন না। সোনারগাঁও উপজেলার হাজী ইকবাল তাদের ভাড়া করে এনেছেন ডাকাতি করার জন্য। তারা আটক হওয়ার পর তিনিই তাদের জামিনের ব্যবস্থা করেন।
এদিকে এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানতে এ চক্রের প্রধান হাজী ইকবালের বক্তব্য জানতে একাধিকবার তার ডকইয়ার্ডে যাওয়া হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। সেখানে কর্মরতরা জানান বেশ কিছুদিন ধরে তিনি এখানে আসছেন না। তার ব্যবহৃত মুঠোফোনে অসংখ্য বার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। চক্রের সদস্য মোহাম্মদ আলী এবং হাবিব উল্লাহর বক্তব্য জানতে তাদের বাড়িতে কয়েকদিন গেলেও তাদের পাওয়া যায়নি। প্রতিবেশীরা জানান ট্রলার শ্রমিকদের জিম্মি করে মালামাল চুরির ঘটনায় তাদের নাম আসার পর পর তারা গা ঢাকা দিয়েছেন।
বিষয়টি সম্পর্কে নৌ পুলিশের নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের পুলিশ সুপার মিনা মাহমুদা বলেন, আলী ও হাবিব উল্লাহ সহ এসব ঘটনার সাথে জড়িত বেশ কয়েকজনের নাম আমরা পেয়েছি তদন্তের স্বার্থে সেগুলো প্রকাশ করা যাচ্ছে না। স্থানীয় লোকসহ বেশ কয়েকজন এসবের সাথে জড়িত বলে আমরা প্রমাণ পেয়েছি। শীঘ্রই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, গত ১ অক্টোবর ও ১৯ অক্টোবর মেঘনা নদীর মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় অংশ থেকে প্রায় আড়াই কোটি টাকার মালামালসহ দুটি ট্রলার ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে সঙ্গবদ্ধ নৌ ডাকাত দল। চলতি বছর অন্তত ছয় বার চক্রটি গজারিয়া উপজেলাধীন মেঘনা নদীতে মালামাল বোঝাই নৌযানে ডাকাতির চেষ্টা করে।