এক সময় “কেরাও নাও” না হলে কোনো বিয়েই যেন মনের মতো হতো না। উনশ শতাব্দীর প্রথম দিকের কথা। বিত্তবান এবং মধ্যবিত্ত মানুষদের কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে ঘোড়ার গাড়ি ও পালকির প্রচলন ছিল। অন্যদিকে পল্লী অঞ্চলের নিম্ম আয়ের মানুষদের ছৈঁয়াল “কেরাও নাও”বা টাপুরে নৌকা ছিল একমাত্র নৌবাহন। কেরাও নাও‘এ চড়ে বরযাত্রী যেতো বিয়ে বাড়িতে আবার নতুন বৌ নিয়ে বরযাত্রী একই নাও‘ইয়ে ফিরে আসতো বাড়িতে। মা-বাবা, নানী-দাদীর” যুগে নববধূকে বউয়ের সাজে সাজিয়ে আনতে ঐতিহ্যবাহী বাহন পালকি, ঘোড়ার গাড়ি আবার পল্লী অঞ্চলে “কেরাও নাও” ছিল যাত্রা পথের একমাত্র সম্বল। এসব বাহন এখন শুধুই সমায়ের স্মৃতি আর ইতিহাস। বর্তমানে আধুনিকতায় সেসব প্রচলন প্রাইভেট কার, মাইক্রো এবং ইঞ্জিনচালিত বোটের প্রভাবে প্রায় অর্ধশত বছর ধরে বিলুপ্তি হতে চলছে গ্রাম-বাংলার “কেরাও নাও”। তবে ছড়িয়ে ছিড়িয়ে “কেরাও নাওয়ের এখনো প্রচলন থাকলেও আগের ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়াতে পারছে না ইঞ্জিনচালিত শ্যালো বোটের বিপরীতে। অন্যদিকে শশুরবাড়ি থেকে নববধূকে নিয়ে আসতে -দু- তিন দিনের দুরপাল্লার যাত্রাপথে ১০/১২ খানা ছৈঁয়াল কেরাও নাওয়ের বহরে বরপক্ষ বেশ ধুমধাম করে বউকে তুলে আনা হতো পল্লী অঞ্চলে নৌ-বাহনে। প্রায় দেড়‘শ বছর আগে কেরাও নাও‘য়ে বউকে তুলে আনার সেই দর্শনীয় দৃশ্য শত বছর আগে হারিয়ে গেছে। গ্রাম-গঞ্জের বিয়ের অনুষ্ঠানে আর পণ্য পরিবহনের জন্য এর গুরুত্বপূর্ণ ছিল ব্যপক। জরুরি অবস্থায় নৌ-পথে এর চাহিদা ইঞ্জিনচালিত শ্যালো বোট দখল করে নিলেও এখনো মাঝে মধ্যে ২/১টা প্রত্যন্ত অঞ্চলে দেখা গেলেও আধুনিক সভ্যতার দাপটে তা বর্তমানে শূণ্যের কোঠায়। বর্ষাকালে “কেরাও নাও”য়ের পল্লী অঞ্চলে যেসব স্থানে সারিবদ্ধভাবে নৌকার মাঝি যাত্রীর অপেক্ষায় দিনরাত বসে থাকতো, সেসব স্থানে এখন সারিবদ্ধভাবে যাত্রীর অপেক্ষায় থাকে ইঞ্জিনচালিত শ্যালো বোটের সারেংরা। যাত্রীরাও কম সময়ে পথ পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে পৌছানোর সুবিধার জন্য চলাচল করছে শ্যালো বোটে। আর এতে প্রতিনিয়ত বিলুপ্তি হতে চলেছে শত বছরের ঐতিহ্য “কেরায়া নাও”। তবে ছৈঁয়াল কেরায়া নাওয়ের প্রচারনার পিছনে রয়েছে মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাব। ইসলাম ধর্মের বিধানে নারীকে পর্দানশীল থাকতে বলা হয়েছে। তাই নারীর ‘আব্রু’ রক্ষার তাগিদে কোথাও যাতায়াত করতে হলে খোলা বা পানসি নৌকার পরিবর্তে ছৈঁয়াল কেরায়া নাওয়েই বেছে নিতেন মুসলিম নারীরা। নৌযাত্রার এ বাহনে পুরুষের চোখ এড়ানোর জন্য নৌকার দুই মাথায় কাপড় টানিয়ে যাত্রা করা হতো। আবার দু-একদিনের দুরপাল্লার যাত্রায় নৌকাতেই রান্নাবান্না আর রাত যাপনের ব্যবস্থা করা হতো। বাশেঁর লগিতে শুকানো হতো জামা-কাপড়। খোল,পাটা, ছই, ছৈঁয়াল, হাল,দাঁড়,পাল, পালের দড়ি, মাস্তÍল, নোঙর, খুঁটির দড়ি, গলুই বৈঠা, লগি, গুন এ গুলো হচ্ছে একটি কেরাও নাওয়ের উপকরণ এসব অংশবিশেষ নিয়েই গড়ে ওঠে “কেরাও নাও”য়ের সংস্কৃতি। স্বরুপকাঠির ১০টি ইউনিয়ন, ১টি পৌর সভায় ৩০ বছর আগেও গড়ে অন্তত এক‘শটি করে সর্বমোট প্রায় ১১ হাজার “কেরাও নাও” ছিল। আজ তার ছিটেফোটাও নেই। এক সময়ে এসব নাওয়ের ওপর নির্ভর করতো স্বরুপকাঠির প্রায় ৭২ হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা। উপজেলাগুলোতে সম্প্রতি এক জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কোনো কোনো এলাকায় ১০ থেকে ১২ জন মাঝি “কেরাও নাও” চালানোর কাজে এখনো নিয়োজিত আছেন। এ পেশায় জড়িত স্বরুপকাঠির হাসেম মাঝি বলেন, আগের মত এ পেশায় রোজগার নাই, “কি খাইয়া যে বাচুম হেইয়া মোরা জানি না রে বাজান”! নূণ আনতে যেন পানতা ফুরিয়ে যায়। একসময় এসব পরিবারগুলো ছেলে মেয়েদের নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন এখন অনেকটা ঘুড়ে দাড়িয়েছে অন্যা পেশার সন্ধান পেয়ে। তার পরেও ক্ষুদ্র একটি অংশ বাপ-দাদার আধিপেশাটিকে ধরে আছেন। কথা হয় স্বরুপকাঠির উদায়কাঠির আফসার মাঝির সঙ্গে। তিনি বলেন, এ পেশায় প্রায় ৩০ বছর ধরে নৌকার মাঝি পেশায় আছি। তয় এখন আগের মত আর ভালো নাই। একট সময় বউ মাইয়া-পোলা লইয়া ভালোই সংসার চলতো। আর এহন নৌকায় মানুষ ওঠে না অল্প সময়ে যাওনের লাইগা ইঞ্জিনচালিত শ্যালো ট্রলারে ওঠে যাত্রীরা। আমরা সারা দিনে একটি ক্ষেপ পাইতেও পারি আবার কোনো কোনো দিন ক্ষেপ নাও পাইতে পারি। এতে কেমনে মাইয়া-পোলা লইয়া সংসার চালাই। হারাদিন যাত্রীর অপেক্ষায় থাহনের পর ২/১টি ক্ষেপ পাই, তাতে যে টাহা পাই হেতে মোগো সংসার চলে না। স্বরুপকাঠি উপজেলার বৃহৎ নৌবন্দর হাটে বসে যুবক- বৃদ্ধ কয়েকজন মাঝি বলেন, ট্রলার অইয়া মোগো ভাত কাইড়া নেছে। কয়দিন এই পেশায় থাহন যাইবে হে মোরা জানি না। ছারছিনার “কেরাও নাও”ঘাটে কথা হয় তোফায়েল উদ্দিন মাঝির সাথে। তিনি বলেন, ছারছিনা নৌকা ঘাটটিকে এখন আর মানুষ নৌকা ঘাট বলে না, ট্রলার ঘাট বা বাস স্টেশন নামে পরিচিত হয়ে উঠছে। এখানে ১০/১২ বছর আগেও ২০/২৫ খান নৌকার মাঝি যাত্রীর অপেক্ষায় সারিবদ্ধভাবে বসে থাকতো। এখন বসে থাকে ইঞ্জিনচালিত শ্যালো বোট আর বাস ড্রাইভার। তবে ১৯৮৮- দশক থেকে বাংলাদেশে নৌকায় স্যালো মোটর লাগানো প্রচালন শুরু হওয়ার পরে এ নৌকার প্রচলন বিলীন হতে চলছে। এ যান্ত্রিক নৌকাগুলো স্যালো নৌকা নামে পরিচিত হয়ে উঠলেও বিলীন হয়ে গেছে গ্রাম-বাংলার “কেরাও নাও”। তার পরেও বলবো শুধু জলযান হয়ে নৌকা তার জীবনাবসান ঘাটায়নি, একসময় হয়েছে আমাদের আনন্দের মাধ্যমও। তাই বেঁচে থাক নদী আর তার মধ্যে রাজত্ব করুক মাঝি তার প্রিয় নৌকাকে নিয়ে।