ইতিহাস থেকে জানা যায়, আদিম বসাক সম্প্রদায়ের লোকদেরই তাঁতি বলা হতো। তবে কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে সেই সোনালী অতীত। ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প এখন ধুঁকছে। তাঁতি শিল্পের সাথে বহু পুরনো সম্পর্ক ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ শহরের হেলাই, বলিদাপড়া, মনোহরপুর, অনুপমপুরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে। একসময় এসব গ্রামের তাঁতি সম্প্রদায়ের লোকেরা ছিলো বেশ সচ্ছল, সমৃদ্ধ ও স্বাবলম্বী। তখন চাহিদা ছিলো ব্যাপক হারে, এ তাতের কাপড়ের কথা শুনলেই চাহিদা ছিল অনেক। কিন্তু এখন বাস্তবতা হচ্ছে তারা ত্যাগ করছে তাদের আদি পেশা। তাদের ব্যবহার্য সুতা রঙ্গিন হলেও জীবন সাদাকালোয় মোড়া। বর্তমানে কিছু তাঁতি সম্প্রদায় এখনও ধরে আছেন এই আদি পেশা। কালীগঞ্জ শহর থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার পথ গেলেই অনুপমপুর গ্রাম। সেখানে আজও মুখরিত হয় সেই তাঁত বুননের শব্দে।
কালীগঞ্জ উপজেলার অনুপমপুর গ্রামের এক সময়কার সচ্ছল তাঁত মালিক জামাত আলির অধীনে চলতো ১০টি তাঁত। পূর্ব পুরুষদের পারিবারিক ভাবে ছিলো তার এ ব্যবসা এ ব্যবসায় পরিবার পরিজন নিয়ে চলতো তাদের সংসার। পরিবারের সদস্যসহ আশেপাশের লোকজন নিয়ে এখানেই বুনন হতো শাড়ি, লুঙ্গী, গামছা, ধুতি সহ নানান ধরনের পরিধেয় বস্ত্র। বর্তমানে এখন মাত্র ৪ টি তাঁত নিয়ে চলছে তার ব্যবসা। পরিবারের অনেকেই তাতের ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। অনুপমপুরের এই সম্প্রদায় ব্যাক্তিরা এখন টিকে আছে কষ্টে। এই গ্রামে এখন ১৮টি পরিবার তাঁতের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এখনও তারা চেষ্টা করছে চরকার চাকা ঘুরিয়ে ভাগ্যের চাকা সচল রাখতে। রফিকুল ইসলাম নামের আরেকজন তাঁতি জানান, তিনি ২টা তাঁত নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। পারিবারিক ভাবে স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধূ নিয়ে এই কাজই করছেন, এ কাজই জীবন জিবিকা নির্ভর করছে। একটি তাঁতে প্রতিদিন ৪ থানে গামছা হয় ৮টা, পাইকারি মূল্য ৩৩০ থেকে ৩৫০ টাকা। এই গামছা তৈরির সুতা আনতে হয় কুষ্টিয়ার বিত্তীপাড়া থেকে। নিজেদের পরিশ্রম, সুতা, রং, চরকা, মাকুর খরচ দিয়ে পোষানো অনেক কষ্টের। পৈতৃক কাজ ছাড়তে পারছেন না বলেই তারা এ ব্যবসা ধরে রেখেছেন। তিনি আরও বলেন, তাঁতের সংখ্যা দিন দিন ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। এতে মন খারাপের কিছু নেই। বর্তমানে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে এমন অবস্থা হয়েছে। এ পরিবর্তনকে মেনে নিতে হবে। কেননা একসময় ঢেঁকিতে ধান ভাঙা হতো, কিন্তু এখন সেই ঢেঁকির ছাঁটা চাল হারিয়ে গেছে, এটাই বাস্তবতা। কিন্তু ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারিভাবে তাঁত শিল্পের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে।
তাজুল ইসলাম জানান, এখন শাড়ীর কাজ হয়না বললেই চলে, কারণ শাড়ীর খরচ পুষিয়ে মূল্য পাওয়া কষ্ট। তাঁতের একটি শাড়ী তৈরিতে সময় লাগে প্রকার ভেদে এক থেকে দুই দিন। খরচ ভেদে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। যা বিক্রি হয় ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা। তাঁতের শাড়ী থেকে মেশিনে তৈরি শাড়ীর চাকচিক্য থাকে বেশি। সময়ের সাথে বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গেলে ব্যবসায়ীক ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রয়োজন। যা এই তাঁত শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা পাচ্ছেন না। এ পেশার সাথে জড়িত মানুষের জন্য নেই প্রয়োজনীয় পেশাগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষনের কোন ব্যবস্থা। যান্ত্রিকতার এই যুগে আজ অসহায় হয়ে পড়েছে অনুপমপুরের তাঁতি শিল্প।
কালীগঞ্জ পৌর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আশাদুল ইসলাম বলেন, তাঁত শ্রমিকদের সময়োপযোগী কোনো প্রশিক্সনের ব্যবস্থা না থাকায় গতানুগতিক সনাতন পদ্ধতিতে পোশাক তৈরির ধারার বাইরে এসে আধুনিক রুচিসম্মত পোশাক তৈরি করতে কষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়া মূলধনের সমস্যা তো রয়েছেই। তাঁত শিল্পে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা একেবারেই কম।তিনি আরও বলেন, তাঁত শিল্প রক্ষায় এ শিল্পের জন্য সুতাসহ সব উপকরণের সহজলভ্যতা ও পর্যাপ্ত ঋণের ব্যবস্থা করা জরুরি। একই সাথে তাঁত শ্রমিকদের জন্য প্রশিক্ষন এবং তাঁত শিল্পের অসুবিধা গুলো চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহন করা।