দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সারা দেশের মতো মৌলভীবাজার-১ জুড়ী -বড়লেখা আসনেও মনোনয়ন প্রত্যাশীরা তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন। এ নিয়ে সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও চলছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। কোন দল থেকে কে মনোনয়ন পাবেন এ নিয়ে সকাল থেকে গভীর রাত অবধি চায়ের কাপ গরম করছেন তারা। বিএনপি আদৌ নির্বাচনে আসবে কিনা এ নিয়েও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে এ আসনের নির্বাচন হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ণ। মাঠে আওয়ামী লীগের কর্মী সমর্থকরা সরব থাকলেও বিএনপির কর্মী সমর্থকরা রয়েছে একেবারে নিরব। দলটির নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, নির্বাচনে যাওয়ার জন্য কেন্দ্রের নির্দেশনা না থাকায় তারা তত্ত্ববধায়ক সরকারের দাবী আদায়ের আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত আছেন। বর্তমানে নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজার-১ আসনে ৩ লাখ ১৫ হাজার ৮৪৫ জন ভোটার রয়েছেন।
মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলা ও বড়লেখা উপজেলা নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের ২৩৫তম আসন মৌলভীবাজার-১। এ আসনে ৭ বার আওয়ামী লীগের নৌকা, ১ বার বিএনপি'র ধানের শীষ ও একবার জাতীয় পার্টির লাঙ্গল মার্কার বিজয় হয়েছে। আওয়ামী লীগ থেকে এ আসনে মোঃ শাহাব উদ্দিন ইতোমধ্যে চার বার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তৃণমূলসহ সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা রয়েছে আকাশচুম্বী। বিগত ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার অন্যতম একক প্রার্থী। ১৯৮৪ সালে প্রথম বড়লেখা উপজেলার সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি নির্বাচিত হন। সে নির্বাচনের পর রাজনীতির মাঠে তাকে আর পেছন ফিরে থাকাতে হয়নি। একটানা ৩ বার ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন। এরপর ১৯৯৬ সালে প্রথম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়ে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট এবাদুর রহমান চৌধুরীকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি অল্প ভোটের ব্যবধানে হেরে গেলেও ২০০৮ এ আবারো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সে ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদে এবং ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে পরপর তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। এছাড়াও ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদে সরকার দলীয় হুইপের দায়িত্ব পালন করেন।
চারবার জাতীয় সংসদ সদস্য, জাতীয় সংসদের হুইপ ও পরিবেশ মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে জুড়ী-বড়লেখার উন্নয়নে তিনি ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। তারমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে জুড়ী উপজেলার লাঠিটিলা বনে দেশের তৃতীয় বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক একনেকে অনুমোদন। ব্যাপক উন্নয়ন করার ফলে আওয়ামীলীগসহ সাধারণ ভোটাররা এখনো আস্থা রেখেছেন মোঃ শাহাব উদ্দিনের উপর। আওয়ামী লীগের এ আসনে মোঃ শাহাব উদ্দিনের বিকল্প এখনো তৈরি হয়নি বলে মনে করেন সাধারণ ভোটার ও আওয়ামীলীগসহ অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
তবে এবার এ আসনে নৌকার মনোনয়ন চাচ্ছেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন। করোনাকালে ও ভয়াবহ বন্যার সময় তিনি বড়লেখা ও জুড়ীর মানুষের জন্য কাজ করেছেন। বিশেষ করে এ আসনে তরুণ প্রজন্মের ভোটারদের কাছে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। ইতোমধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন পেতে তিনি দলীয় মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন। এ আসনে এস এম জাকির হোসাইন ছাড়াও দলীয় মনোনয়ন জমা দিয়েছেন কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক সদস্য অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম, বড়লেখা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম সুন্দর ও জুড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম।
জানা যায়, ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী মোঃ শাহাব উদ্দিনকে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো বিএনপি এ আসনে জয়লাভ করে। নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী অ্যাডভোকেট এবাদুর রহমান চৌধুরী ৪৯ হাজার ২শ ৮১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী মোঃ শাহাব উদ্দিন ভোট পান ৪৭ হাজার ৫শ ৩৯ ভোট। নির্বাচিত হয়ে অ্যাডভোকেট এবাদুর রহমান বিএনপি সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
বিগত ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি'র ধানের শীষের প্রার্থী জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন আহমেদ মিঠু আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোঃ শাহাব উদ্দিনের কাছে পরাজিত হন। এ নির্বাচনে তিনি ৬৫ হাজার শ ১৪ ভোট পেয়ে পরাজিত হন। তবে বিএনপিতে এখন পর্যন্ত একমাত্র ভরসা নাসির উদ্দিন আহমেদ মিঠু।
এক সময়ে জাতীয় পার্টি এ আসনে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী আহমেদ রিয়াজ উদ্দিন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোঃ শাহাব উদ্দিনের কাছে পরাজিত হন। এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে মাঠে চষে বেড়াচ্ছেন এবং দলীয় মনোনয়ন পেতে লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে জামায়াতে ইসলামি থেকে একক পার্টি হিসেবে মাঠে রয়েছেন কেন্দ্রীয় জামায়াত নেতা মোঃ আমিনুল ইসলাম। এছাড়া জুড়ী উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু তৃণমূল-বিএনপি থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। আলাপকালে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, তৃণমূল-বিএনপি থেকে আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হলে বড়লেখা জুড়ীর উন্নয়নে কাজ করব।
আলাপকালে জুড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুল খালেক, যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক রিংকু রঞ্জন দাস ও বদরুল ইসলাম বলেন, আমাদের এ আসনের মাননীয় মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিন একজন সৎ, বিনয়ী, সাদামনের ও কর্মীবান্ধব নেতা। এ ছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথে ওঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সাথে সম্পর্ক আছে বলেই এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে জুড়ী উপজেলার লাঠিটিলায় বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক একনাকে পাস হয়েছে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে এ সংসদীয় আসনে মোঃ শাহাব উদ্দিনের বিকল্প কেউ নেই।
বড়লেখা উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সিরাজ উদ্দিন বলেন, আমাদের এ সংসদে আসন থেকে চারজন নৌকার মনোনয়ন চেয়েছেন। তাদের মধ্যে সিনিয়র হিসেবে আমাদের মাননীয় মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিন রয়েছেন। নেত্রী যাকে নৌকা প্রতীক দেন আমরা তাঁর পক্ষে কাজ করব।
বড়লেখা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ একেএম হেলাল উদ্দিন বলেন, এ আসনের মাননীয় পরিবেশ মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিন ইতোমধ্যে বড়লেখা জুড়ীর ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। এ আসনে মোঃ শাহাব উদ্দিনের কোন বিকল্প নেই।
এসএম জাকির হোসাইন মুঠোফোনে জানান, করোনা ও বন্যার সময় বড়লেখা ও জড়ীর মানুষের জন্য কাজ করেছি। ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তরুণ প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি হিসেবে আমাকে মনোনয়ন দিলে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে কাজ করব।
মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন আহমেদ মিঠু বলেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে আমরা আন্দোলনে আছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ সরকারের পাতানো নির্বাচনে বিএনপি কখনো অংশ নেবে না।
আলাপকালে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিন এমপি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সারা দেশের ন্যায় জুড়ী বড়লেখায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। একনেক সভায় জুড়ীতে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আমি আশাবাদী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে আবারো মনোনয়ন দেবেন।