মূলত লেগ স্পিনার হলেও রিশাদ হোসেনের ব্যাটের হাত খারাপ নয়। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৯৯ রানের ইনিংস আছে তার। ঝড়ো ইনিংস খেলার সামর্থ্যও ঘরোয়া ক্রিকেটে নানা সময়ে দেখিয়েছেন। এবার আরেকটু বড় জায়গায় নিজের ব্যাটিং দক্ষতা মেলে ধরলেন তরুণ এই ক্রিকেটার। দু-একটি ছক্কা বা ক্যামিও ইনিংস নয়, উপহার দিলেন বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যানের মতোই বিধ্বংসী এক ইনিংস! নিউ জিল্যান্ডে প্রস্তুতি ম্যাচে সাত নম্বরে নেমে ১১ চার ও ৪ ছক্কায় ৫৪ বলে ৮৭ রানের ইনিংস খেলেছেন রিশাদ। এছাড়াও ঝড়ো ফিফটি করেছেন ওপেনার তানজিদ হাসান তামিম। পঞ্চাশ পেরিয়েছেন সৌম্য সরকার, লিটন কুমার দাসও। সব মিলিয়ে বলা যায়, ব্যাটসম্যানদের প্রস্তুতি খারাপ হয়নি। লিঙ্কনে বৃহস্পতিবার প্রস্তুতি ম্যাচে নিউ জিল্যান্ড একাদশকে ২৬ রানে হারায় বাংলাদেশ। বার্ট সাটক্লিফ ওভালে বাংলাদেশ ৪৯.৫ ওভারে অলআউট হয় ৩৩৪ রানে। বোলারদের প্রস্তুতি অবশ্য খুব আদর্শ হয়নি। ৮০ রানে ৪ উইকেট হারিয়েও নিউ জিল্যান্ড একাদশ শেষ পর্যন্ত তুলে ফেলে ৩০৮ রান। বাংলাদেশের মূল বোলারদের সবাই অবশ্য পুরো ওভার বোলিং করেননি। মুস্তাফিজুর রহমান, হাসান মাহমুদরা স্রেফ ৬ ওভার করে বোলিং করেন। মূল স্কোয়াডের বাইরে প্রস্তুতির জন্য সঙ্গে যাওয়া মুশফিক হাসানও দুই ওভার বোলিং করেন। ব্যাটিংয়ের পর বল হাতেও রিশাদ নেন তিন উইকেট। তিন উইকেট শিকার করেন আফিফ হোসেনও। বাংলাদেশের স্কোয়াডের যারা প্রথম ভাগে নিউ জিল্যান্ডে পৌঁছেছেন, তারাই মূলত খেলেছেন এই ম্যাচে। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ শেষ করে বুধবার দলে সঙ্গে যোগ দেওয়া অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত, সহ-অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ, অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিম ও পেসার শরিফুল ইসলাম ছিলেন বিশ্রামে। এই প্রস্তুতি ম্যাচ থেকে অবশ্য খুব বেশি আশার ছবি দেখা কঠিন। নিউ জিল্যান্ড একাদশে অধিনায়ক ভারাত পিপলি ও অলরাউন্ডার জ্যাকব ভুলা ছাড়া সবাই খুবই অনভিজ্ঞ। একদম অচেনা নামও আছে কয়েকজন। মূল সিরিজের চ্যালেঞ্জটা হবে অনেক বেশি কঠিন। বার্ট সাটক্লিফ ওভালে এই ম্যাচে কোনো টস হয়নি। আগে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে তানজিদ ও এনামুল হক ভালো শুরু এনে দেন দলকে। ৭ ওভারে ৪৭ রান তোলেন দুজন। বাউন্ডারি আসতে থাকে প্রায় প্রতি ওভারেই। জেমস শার্টশর্নের শর্ট বলে হুক করে ছক্কা মারেন এনামুল। আগে বিদায় নেন এনামুলই। জোয়ি ফিল্ডের ফুল লেংথ বল তার ব্যাট-প্যাডের ফাঁক গলে ছোবল দেয় স্টাম্পে। ৪ চার ও ১ ছক্কায় ৩১ বলে ৩৩ করেন তিনি। দ্বিতীয় উইকেটে শতরানের জুটি গড়েন তানজিদ ও সৌম্য। তৃতীয় বলে চার মেরে শুরু করেন সৌম্য। এরপর উত্তাল হয়ে ওঠে তানজিদের ব্যাট। চারটি দারুণ ছক্কা মারেন তিনি। বাঁহাতি স্পিনার নিকিথ পেরেরাকে এক্সট্রা কাভারের ওপর দিয়ে মারেন প্রথমটি, পরেরটি জ্যাকব ভুলার অফ স্পিননে চমৎকার লফটেড অফ ড্রাইভে। সোর জ্যারড ম্যাকাইয়ের শর্ট বলে পুল করে মারেন তৃতীয় ছক্কা। সাম্রাথ সিংকে ডাউন দা উইকেট উড়িয়ে ফিফটি পূর্ণ করেন তিনি ৪০ বলে। এরপর তার ইনিংস বেশি দূর এগোয়নি। বাঁহাতি স্পিনার পেরেরাকে হাঁটু গেড়ে উড়িয়ে মেরে লং অনে ধরা পড়েন তিনি ৪৬ বলে ৫৮ রান করে। চার ছক্কার পাশে তার ইনিংসে বাউন্ডারি ছিল পাঁচটি। ৮ চার ও ১ ছক্কায় সৌম্যর ফিফটি আসে ৪৯ বলে। তবে এরপরই একটু থমকে যান তিনি। শেষ পর্যন্ত ৭১ বলে ৫৯ রান করে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান আউট হন পেসার সাম্রাথ সিংয়ের বলে কাভারে ক্যাচ দিয়ে। এরপর তাওহিদ হৃদয় ও আফিফ হোসেনকে দ্রুত হারায় বাংলাদেশ। লেগ স্টাম্পে থাকা বলে ফ্লিক করে শর্ট ফাইন লেগে ধরা পড়েন হৃদয় (০)। অফ স্টাম্পের বাইরের বল অন সাইডে টেনে মারতে গিয়ে বল স্টাম্পে টেনে আনেন আফিফ (১০)। ১৪ রানের মধ্যে ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। এক প্রান্তে তখন লিটন আছেন বটে, তবে আরেক প্রান্তে ছিল না আর কোনো প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যান। ইনিংসের তখনও বাকি প্রায় ২২ ওভার। তবে ব্যাটসম্যানের সেই ঘাটতি অবশ্যই বুঝতেই দেননি রিশাদ। দারুণ ব্যাটিংয়ে এগিয়ে নেন দলকে। লিটনের সঙ্গে রিশাদের জুটিতে আসে ৭০ রান। ৬৩ বলে ৫৫ রান করে বিদায় নেন লিটন। ইনিংসের তখনও ১১ ওভারে বেশি বাকি। সেই সময়টায় বলতে গেলে একাই রান বাড়ান রিশাদ। দুর্দান্ত সব শট খেলে নিজের ব্যাটিং প্রতিভার জানান দেন তিনি। ৩৪ বলে ফিফটি স্পর্শ করে এগিয়ে যান আরও অনেকটা। শেষ পর্যন্ত ইনিংস শেষের এক বল আগে আউট হন তিনি বড় শটের চেষ্টায়। রান তাড়ায় নিউ জিল্যান্ড একাদশ খুব ভালো শুরু করতে পারেনি। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে এখনও কোনো স্বীকৃত ম্যাচ না খেলা ওপেনার জ্যাকব কামিং চারটি চার মারেন হাসান মাহমুদের দুই ওভারে। কিন্তু হাসানের অফ স্টাম্পের বাইরের বলেই ব্যাট চালিয়ে কিপারের কাছে ধরা পড়েন তিনি ১৮ রানে। হাসানের বল আলতো করে মিড অনে তুলে দিয়ে আউট হন আরেক ওপেনার জ্যাকব ভুলা। এরপর অধিনায়ক ভারাত পপলি জুটি গড়ার চেষ্টা করেন কুইন সুন্দের সঙ্গে। কিন্তু ২৩ রান করে সুন্দে আউট হন তানজিম হাসানের ভেতরে ঢোকা বলে উইকেটের পেছনে লিটন দাসের দারুণ ক্যাচে। পাঁচে নামা জামাল টড উইকেট যাওয়ার পরপরই আফিফ হোসেনকে রিভার্স সুইপ করার চেষ্টায় বল টেনে আনেন স্টাম্পে। কিউইদের রান তখন ৪ উইকেটে ৮০। পপলি ও সান্দিপ প্যাটেল সেখান থেকেই গড়ে তোলেন দারুণ এক জুটি। ২১ ওভারে ১৫৬ রান যোগ করেন দুজন। সেঞ্চুরির পথে থাকা পপলিকে ফিরিয়ে এই জুটি ভাঙেন আফিফ। ১৩ চারে ৯০ বলে ৯২ রান করে নিউ জিল্যান্ড অধিনায়ক বোল্ড হন ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে ড্রাইভ করার চেষ্টায়। সান্দিপ এরপরও ছুটছিলেন ঝড়ের গতিতে। তাকেও থামান আফিফ। ১১ চার ও ২ ছক্কায় ৭৭ বলে ৮৯ রান করে আফিফের লেগ স্টাম্পে থাকা শর্ট বলে পুল করে সীমানায় ধরা পড়েন তিনি। এরপর লোয়ার অর্ডারদের প্রচেষ্টায় তিনশ ছাড়ায় নিউ জিল্যান্ডের রান। শেষ দিকে তিনটি উইকেট নেন রিশাদ। ওয়ানডে দলে প্রথমবার ডাক পাওয়া রাকিবুল হাসান প্রস্তুতি ম্যাচে খুব ভালো করতে পারেননি। ১০ ওভারে ৬১ রান দিয়ে ১ উইকেট নেন তরুণ বাঁহাতি স্পিনার। প্রস্তুতি শেষে এবার মূল সিরিজের চ্যালেঞ্জ। তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের প্রথমটি রোববার ডানেডিনে। নিউ জিল্যান্ডে তাদের বিপক্ষে কখনোই সীমিত ওভারের কোনো ম্যাচ জিততে পারেনি বাংলাদেশ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৪৯.৫ ওভারে ৩৩৪ (তানজিদ ৫৮, এনামুল ৩৩, সৌম্য ৫৯, লিটন ৫৫, হৃদয় ০, আফিফ ১০, রিশাদ ৮৭, তানজিম ৩, রাকিবুল ২, হাসান ৮, মুস্তাফিজ ১*; হার্টশর্ন ৭.৫-০-৫৭-২, ফিল্ড ৯-০-৬২-২, পেরেরা ১০-১-৫৫-১, ভুলা ৩-০-১৯-০, ম্যাকাই ১০-০-৬১-১, সাম্রাথ ১০-০-৭৩-৪)।
নিউ জিল্যান্ড একাদশ: ৪৯.৩ ওভারে ৩০৮ (কামিং ২২, ভুলা ৮, পপলি ৯২, সুন্দে ২৩, টড ১, সান্দিপ ৮৯, পোমারে ৪, পেরেরা ১০, ফিল্ড ৩৩*, সাম্রাথ ১০, হার্টশর্ন ৩; মুস্তাফিজ ৬-০-৩৬-০, হাসান ৬-০-৩৬-২, সৌম্য ৪-০-২৫-০, তানজিম ৮-১-৪৮-১, রাকিবুল ১০-০-৬১-১, আফিফ ৬-০-২৬-৩, রিশাদ ৭.২-০-৫২-৩, মুশফিক ২-০-২০-০)।