সিংড়ার চলনবিলের কৃষকের অল্প খরচে জমিতে সেচ সুবিধা ও ফসলকে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা এবং এলাকার কৃষকদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন তরান্বিত করাসহ নানাবিধ সুবিধার্থে খনন করা হুলহুলিয়া-টু-সারদানগর খাল অসময়েই শুকিয়ে মাছ শিকার করা হচ্ছে। আর উন্মুক্ত সরকারি জলাশয়ের মাঝে মাঝেই অবৈধ বাঁধ নির্মাণ করে বিলের মধ্য থেকে কৃষিপণ্য আনা-নেওয়ার একমাত্র বাহন নৌকা চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রকৃত মৎস্যজীবি ও দিন মজুররা ওই খালে মাছ ধরতে না পেরে অতিকষ্টে জীবন যাপন করছেন এবং হুমকির মুখে পড়েছে চলনবিলের দেশীয় প্রজাতির মাছ ও জীববৈচিত্র্য। অভিযোগ উঠেছে হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও চৌগ্রাম ইউনিয়নের ১নম্বর ওয়ার্ড আ.লীগের সভাপতি আল তৌফিক পরশ মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এই খালটি বেঁচে দেওয়ায় কৃষি জমিতে সেচ শুরুর আগেই শুকিয়ে মাছ ধরার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন স্থানীয় আ.লীগ কর্মীরা। আর এই খাল চারটি অংশে ভাগ করে প্রায় ৫ লক্ষাধিক টাকায় কেনা-বেঁচা হয়েছে বলে ক্রেতা ও নাম প্রকাশে এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে। জানা যায়, পাবনা-নাটোর-সিরাজগঞ্জ জেলায় ভূ-উপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২০২০-২১ ও ২০২২-২৩ অর্থ বছরে প্রায় ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সিংড়ার হুলহুলিয়া-টু-জয়নগর বিল এবং হুলহুলিয়া-টু-সারদানগর (নিয়ামত ব্রাঞ্চ) খালের ৫ কিলোমিটার অংশ পুনঃ খনন করা হয়। আর খালটি পুনঃ খননের ফলে এলাকার কৃষি জমিতে অল্প খচরে সেচ সুবিধা, ভূ-পরিস্থ পানির প্রাপ্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানো, অতি বৃষ্টি জনিত কারণে জলাবদ্ধতার হাত থেকে ফসলকে রক্ষা, কৃষিপণ্য আনা-নেওয়া, বিলের মাছ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষাসহ কৃষকের সকল কাজে সুযোগ-সুবিধা বাড়বে। কিন্তু সরেজমিনে চোখে পড়ে তার উল্টো চিত্র, হুলহুলিয়া খালের শুরুতেই স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করে অসময়েই বিদ্যুৎ চালিত মোটর দিয়ে পানি শুকিয়ে মাছ শিকারের ব্যবস্থা করছেন স্থানীয় আ.লীগ কর্মী আলমগীর হোসেন ও বিদ্যুৎ শেখ। এখান থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পর পর খালে আরো পাঁচটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এই অংশটি তারা একলাখ ৭০ হাজার টাকায় কিনে মাছ শিকারের ব্যবস্থা করছেন বলে জানান খালে সেচ কাজে ব্যস্ত বিদ্যুৎ শেখ। তিনি আরো জানান, খালটি তারা আ.লীগ নেতা আল তৌফিক পরশের কাছ থেকে কিনেছেন। তিনিই বিস্তারিত বলতে পারবেন। আর এই খালের পশ্চিমাংশে সারদানগর এলাকার শেষ সীমানা পর্যন্ত খাল দখল করে মাছ শিকারের প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং সেখানে রাত্রি যাপনের ছাউনী ফেলেছেন আ.লীগ কর্মী মানিক, আজাদুল, হারিছ ও ভুলু মিয়া। সেখানে দেখ ভালের দায়িত্বে নিয়োজিত মানিক উদ্দিন বলেন, খালের এই অংশটুকু তারা ৭৫ হাজার টাকায় আ.লীগ নেতা আল তৌফিক পরশের কাছ থেকে কিনেছেন। তবে এভাবে সরকারি খাল কেনা-বেঁচা করা ও দখল করে শুকিয়ে মাছ ধরা কি বৈধতা আছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আপনার কোন কিছু বলা বা জানার থাকলে হুলহুলিয়ার গ্রাম চেয়ারম্যান আল তৌফিক পরশের কাছে গিয়ে জিগান। এছাড়াও হুলহুলিয়া খালের একটি অংশ দখল করে নিয়েছেন ওই গ্রামের মাসুদ মিয়া। তিনি এই অংশটি একলাখ ৯২ হাজার টাকায় কিনে দখল করেছেন বলে জানা গেছে। এছাড়াও খালের আরেকটি অংশে বাঁধ দিয়ে দখলের চিত্র চোখে পড়ে। খালের পাশে দাঁড়িয়ে কথা হয় স্থানীয় কৃষক আবদুল মজিদ ও গোলাম মুকুল এর সাথে তারা জানান, এভাবে খাল কেনা-বেঁচা করায় এলাকার সাধারণ কৃষক ও কৃষির জন্য অনেক ক্ষতি হচ্ছে। আর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই জানান, সরকারি খাল বেঁচা-কেনার সুবাদে কৃষির ক্ষতির পাশিপাশি চলনবিলে মাছ ও অর্থ অনেকেই পকেটে তুলছেন এবং রাতারাতি আঙুল ফুলে কলা গাছে রুপান্তরিত হচ্ছেন। এ বিষয়ে হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় ওয়ার্ড আ.লীগের সভাপতি আল তৌফিক পরশ মুঠোফোনে খাল বিক্রয়ের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, খাল বিক্রয়ের সকল অর্থ গ্রামের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখানে তার নিজের কোন লাভ বা স্বার্থ নেই। আর তার গ্রামের পাশেও তো আরো অনেক খাল এভাবে কেনা-বেঁচা হয়েছে। তাহলে তারা করলে দোষের কি? তবে খাল বিক্রয়ে কত টাকা পেয়েছেন এবং কিভাবে ব্যয় হয়েছে সে বিষয়ে জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি। এ বিষয়ে বিএডিসি সিংড়া জোন এর সহকারী প্রকৌশলী (ক্ষুদ্রসেচ) মানিক রতন বলেন, চলনবিলের কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে খালগুলো খনন করা হয়েছে। খাল দখলের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে অবগত করা হয়েছে। সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহাদৎ হোসেন বলেন, মৎস্য সংরক্ষণ ও সুরক্ষা আইনে সরকারি খাল দখল করে অসময়ে এভাবে শুকিয়ে মাছ শিকার অবৈধ। সিংড়ার ইউএনও মাহমুদা খাতুন বলেন, খাল দখলমুক্ত করতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।