দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা কিশোরগঞ্জে রাজনীতির ভোটের মাঠে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। এজন্য এই আসনে নৌকা আর ঈগলের মুখোমুখি ভোটযুদ্ধের পাশাপাশি লাঙল প্রতীকের জমজমাট লড়াইয়ের আভাস পাওয়া গেছে। ফলে ত্রিমুখী লড়াইয়ে এই আসনে শেষ পর্যন্ত কোনো অঘটনও ঘটে যেতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। প্রার্থী-কর্মী-সমর্থকেরা ছুটছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। এ সুযোগে সাধারণ মানুষ নির্বাচনে এমন প্রার্থীদের ভোটে নির্বাচিত করতে চান, যিনি হবেন সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত। গণসংযোগ ও লিফলেটে প্রচারের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তারা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রার্থীদের নিজ এলাকায় নিজের ও দলীয় প্রধানের ছবিসহ পোস্টার এখন শোভা পাঁচ্ছে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ও বিভিন্ন এলাকার আনাচে-কানাচে।
প্রশাসন তথা জেলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিশোরগঞ্জ-১ (সদর-হোসেনপুর) আসনটি ভিআইপি হিসেবে পরিচিত। কেননা দলমত নির্বিশেষে জাতীয় রাজনীতিতে অনন্য অবদান রাখা প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এ আসন থেকেই বারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এখনো সংসদীয় এলাকার মানুষ তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। তাই এই আসনটি সাধারণ মানুষের কাছে খুবই মর্যাদাপূর্ণ।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এই আসনে ভোটযুদ্ধে মাঠে রয়েছেন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশের কংগ্রেস পার্টি, ইসলামি ঐক্যজোট, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপি। তবে স্থানীয় ভোটাররা বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অনেকে রাজনীতির মাঠে তেমন পরিচিত নন। কাজেই, তাদের নিয়ে কোনো আলোচনাও নেই। এখানে মূল লড়াই হবে ছোটবোন আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপির (নৌকা) সঙ্গে বড়ভাই স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক সামরিক সচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ সাফায়েতুল ইসলাম (ঈগল)।
তারা দুজনেই মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের সন্তান ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সহোদর ভাইবোন। দেশের ঐতিহ্যবাহী সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হয়েও ভোটের মাঠে ভাইবোনের মুখোমুখি এই লড়াইয়ের বিষয়টি সংসদীয় এলাকাসহ সর্বত্রই আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে চলছে আলোচনা। দলীয় নেতাকর্মীরাও পড়েছেন অস্বস্তিতে। তবে দুই ভাইবোনের কর্মী-সমর্থকেরা ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে বিষয়টিকে স্বাভাবিক বলছেন।
দুই ভাইবোনের বাইরে এই আসনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নির্বাচনী মাঠে বেশ সক্রিয় রয়েছেন জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের ডা. মো. আব্দুল হাই। এক সময়ের বাম ঘরনার এই রাজনীতিক কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে তিনি কিশোরগঞ্জ জেলার দলটির যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পান। তাছাড়া দলমত নির্বিশেষে নানা শ্রেণি পেশার মানুষের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বের পরিচিত এবং শিশু বিশেষজ্ঞ ‘গরিবের ডাক্তার’ হিসেবে এলাকায় তার বেশ সুনাম রয়েছে।
এ জন্য এই আসনে নৌকা আর ঈগলের মুখোমুখি ভোটযুদ্ধের পাশাপাশি লাঙল প্রতীকের জমজমাট লড়াইয়ের আভাস পাওয়া গেছে। ফলে ত্রিমুখী লড়াইয়ে এই আসনে শেষ পর্যন্ত কোনো অঘটনও ঘটে যেতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী।
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলায় পৌরসভাসহ ১১টি ইউনিয়ন এবং হোসেনপুর উপজেলায় পৌরসভাসহ ৬টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ আসনের নির্বাচনী এলাকা। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কিশোরগঞ্জ-১ (পাকুন্দিয়া-হোসেনপুর) আসনটি বিলুপ্ত করে জেলার সাতটি আসনের পরিবর্তে ছয়টি সংসদীয় আসনে পুনর্বিন্যাস করা হয়। এতে সদর উপজেলার সঙ্গে হোসেনপুরকে যুক্ত করে দিয়ে গঠিত হয় কিশোরগঞ্জ-১ সংসদীয় আসন।
জেলা নির্বাচন অফিসের সর্বশেষ তথ্যমতে, কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলায় সর্বমোট ভোটার সংখ্যা তিন লাখ ২২ হাজার ২৩৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ এক লাখ ৬২ হাজার ৬৪৯ জন ও মহিলা এক লাখ ৫৯ হাজার ৫৮৯ জন। অন্যদিকে হোসেনপুর উপজেলায় সর্বমোট ভোটার সংখ্যা এক লাখ ৪৮ হাজার ৮২৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৭৫ হাজার ৬০৪ জন ও মহিলা ভোটার ৭৩ হাজার ২২১ জন।
১৯৭৩ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ৮টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত ছিল কিশোরগঞ্জ-৩ আসন। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তিতে এ আসনের টানা পাঁচবারের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
তিনি বাবার উত্তরসূরি হয়ে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। পরে ২০০৮ সালে নির্বাচিত হয়ে সৈয়দ আশরাফ মহাজোট সরকারের স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে তিনি টানা দুইবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করেন। এর আগে ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সময়ে দলের ক্রান্তিলগ্নে দলের হয়ে অসাধারণ ভূমিকা পালন করায় তিনি আবির্ভূত হন ‘সফলতার প্রতীক’ হিসেবে। তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যের পাশাপাশি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ব্যাংককের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিএনপি মনোনীত প্রার্থী সাবেক ঢাকা বিভাগীয় স্পেশাল জজ রেজাউল করিম খান চুন্নুকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর বিদেশে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি সৈয়দ আশরাফ মৃত্যুবরণ করেন। এরপর উপনির্বাচনে তারই ছোটবোন ডা. সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি দলীয় মনোনয়নে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের হাইকমাণ্ডের আনুকূল্য পেয়ে দলীয় মনোনয়ন নৌকা প্রতীক পেয়েছেন।
বর্তমান সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি মনোনয়ন পেয়ে তিনি দলীয় নেতাকর্মীর পাশাপাশি তার সহোদর অপর দুইভাই অধ্যাপক মঞ্জুরুল ইসলাম ও অধ্যাপক শরীফুল ইসলাম এবং কনিষ্ঠ বোন সৈয়দা রাফিয়া নূর রূপা এমপি লিপিকে এলাকায় গণসংযোগ-জনসমাবেশে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ সময় তারা ভোটারদের শেখ হাসিনার মনোনীত নৌকার পক্ষে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তবে এমপি লিপির নির্বাচিত হয়ে বিগত দিনে এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ কম থাকায় তূণমূল নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটারদের মাঝে এমপিকে নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
অন্যদিকে এমপি লিপির বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটযুদ্ধে নেমেছেন সহোদর বড়ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) সৈয়দ সাফায়েতুল ইসলাম। তাকে সমর্থন দিয়ে ইতোমধ্যে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন সৈয়দ পরিবারের আরেক সন্তান চাচাত ভাই জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটু। ফলে এ আসনে এখন মুখোমুখি লড়াই হবে আপন ভাই ও বোনের মধ্যে।
বড়ভাই সৈয়দ সাফায়েতকে সমর্থনের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রত্যাহারের দিন মতবিনিময়ে সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটু অনুসারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা নৌকার বিরুদ্ধে নই। আমরা পরিবর্তন চাই, যোগ্য নেতৃত্ব চাই। স্বতন্ত্র রাখার মাধ্যমে নেত্রী সে সুযোগ করে দিয়েছেন’। একই মঞ্চে সৈয়দ সাফায়েত বোন ডা. লিপির নানা অযোগ্যতা তুলে ধরে বলেন, বড়ভাই সৈয়দ আশরাফ যে উন্নয়ন কাজ করে গেছেন, এরপর আর কিছুই হয়নি। বাবা ও ভাইয়ের সুনাম এবং সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে প্রার্থী হয়েছি।
নির্বাচনে কোন কারচুপি নয় বরং সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, নির্বাচিত হয়ে প্রথমেই জনস্বার্থে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের আমূল সংস্কারের পাশাপাশি শহরের বুকচিরে বয়েচলা নরসুন্দা নদীর পুনঃখনন উন্নয়ন কাজসহ হোসেনপুর উপজেলা থেকে গফরগাঁও পর্যন্ত রেলসড়ক নির্মাণের উদ্যোগী হব। পাশাপাশি সারাবছর এলাকার মানুষের সুখেদুখে পাশে থাকারও অঙ্গীকার করেন।
এ ছাড়াও এ আসনে ভোটযুদ্ধে বাংলাদেশের কংগ্রেস পার্টির মোবারক হোসেন (ডাব), ইসলামি ঐক্যজোটের মো. আশরাফ উদ্দিন (মিনার), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের মো. আব্দুল আউয়াল (ছড়ি) ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপির মো. আনোয়ারুল কিবরিয়া (আম) প্রতীক পেয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। তবে স্থানীয় ভোটারদের মতে, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অনেকে রাজনীতির মাঠে তেমন পরিচিত নন। কাজেই, তাদের নিয়ে কোনো আলোচনাও নেই।
স্থানীয় রাজনৈতিক বোদ্ধাদের মতে, দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি ভোট বর্জন করায় নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি প্রার্থীরা প্রচার ও ব্যক্তিগত ইমেজে ভোটারদের কেন্দ্রে এসে নির্ভয়ে ভোট দিতে নিরলসভাবে কাজ করতে হবে। ভোটের মাঠে প্রচারণায় আওয়ামী লীগের দলীয় গ্রুপিং এখন স্পষ্ট। এ ক্ষেত্রে নিজেদের কোন্দলের ফলে এ আসনটি না হাতছাড়া করেই মাশুল দিতে হয়? তবে স্থানীয় নেতাকর্মীরা মনে করেন, বড় দলের বিভক্তি খুব স্বাভাবিক। তবে নেত্রী যাকে মনোনয়ন দিয়েছেন তার পক্ষে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন।