যশোরের যশ খেজুরের রস এ কথা দেশবাসী সবাই জানে। প্রতিবছর খেজুরের রস দিয়ে তৈরি হওয়া গুড় ও পাটালি নিয়ে এক বিশাল গুড়ের হাট বসে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ শহরের নীমতলা বাসষ্টান্ড এলাকায় ব্যাপক ভাবে জমে উঠেছে। কালীগঞ্জ ঝিনাইদহ মহাসড়কের পাশে শহরের নিমতলা বাসস্ট্যান্ডে শীত মৌসুমের সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার ও সোমবার এই হাট বসে। প্রতিবছর শীত মৌসুমে এ এলাকায় খেজুরের রস বেশি হওয়ায় এলাকার কৃষকরা খেজুরের গুড় ও পাটালি উৎপাদন করে থাকে। হাটের দিনে প্রচুর খেজুরের গুড় ও পাটালি নিয়ে আসে বিভিন্ন গ্রাম থেকে। তাই বাইরের ব্যবসায়ীদের কাছে কালীগঞ্জ গুড়ের হাট নামেও ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। বৃহত্তম যশোর অঞ্চলের মধ্যে এই হাট এখনও টিকে আছে। এই হাট কালীগঞ্জ নিমতলা এলাকার একটি ঐতিহ্য। কালীগঞ্জ,ঝিনাইদহ,কোটচাদপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত খেজুর গুড় ও পাটালি বিক্রির জন্য এখানে নিয়ে আসেন। বাজার ঘুরে চাষী ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক হাড়ি/কলস (মাটির তৈরি) পত্রে ৮-১০ কেজি ওজনের গুড় বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৬০০ টাকা দরে। আর ঝোল (তরল) গুড় বিক্রি হচ্ছে এক কলস ৭০০ থেকে ৯০০ টাকায়। রস থেকে তৈরিকৃত পাটালি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দরে। দেশের অন্য গুড়ের হাট থেকে এই হাটে ভালো মানের গুড় ও পাটালি এবং দামে তুলনামূলক কম থাকায় দেশের বিভিন্ন স্থানের গুড় ব্যবসায়ীরা এগুলো ক্রয় করে ঢাকা, বরিশাল, চট্রগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহীতে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করছে। রাজশাহীর গুড় ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম ও জামাল হোসেন জানান, আমরা প্রতি হাটে রাজশাহী থেকে কালীগঞ্জে গুড় ও পাটালি কিনতে আসি। এখানের গুড় ও পাটালিতে রসের গন্ধ যেন মুখে লেগে থাকে। তাই ক্রেতারাও কালীগঞ্জের খেজুরের গুড়ের কথা বললে তা কিনতে অতি আগ্রহ বোধ করে। কালীগঞ্জ থেকে প্রতি সপ্তাহে ২/৩ ট্রাক গুড় সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসায়ীরা পাঠায়। কালীগঞ্জ গুড়ের হাটের চাহিদা টা অনেকটা বেশি বিভিন্ন এলাকায়। অবশ্য এবছর বিগত বছরের তুলনায় এবার গুড় পাটালি অনেকটা কম উঠছে এ বারনে দাম অনেকটা বেশি বলে কৃষক ও ব্যবসায়িরা জানান। কৃষকরা বলছে মাঠে আগের ন্যায় তেমন একটা খেজুর গাছ নেই যে কারণে গুড় ও রস উৎপাদন কম হচ্ছে। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার রামনগর গ্রামের মহিদুল ইসলাম জানান, তিনি প্রায় ৪০ বছর ধরে গুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করেন। তার নিজের রয়েছে প্রায় ৪৭ খেজুর গাছ। তিনি বলেন, খেজুর গাছ থেকে ৮-৯ কলস (মাটির তৈরি) রশ পেলে মাটির এক কলস (৮-১০) কেজি ভাল গুড় হয়। তিনি বলে, এক কলস ভালো গুড় বর্তমানে ১২০০ থেকে ১৬০০ টাকায় বিক্রি করতে পারছে এ বছর। মহিদুল ইসলাম আরো জানান, নিজে খেজুর গাছ কেটে নিজেই গুড় তৈরি করে থাকে। এক কলস রস বিক্রি হচ্ছে এবছর ৩০০ টাকা দরে। পিঠা পায়েশ তৈরির জন্য গ্রামবাসি তাদের কাছ থেকে সকালে রস ক্রয় করেন। কোটচাদপুর উপজেলার এলাঙ্গি গ্রামের জাহাঙ্গির আলম কৃষক বলেন, তাদের গ্রামের উৎপাদিত খেজুরের গুড়ের ব্যাপক কদর রয়েছে দীর্ঘ বছর ধোরে। কালীগঞ্জ গুড়ের হাটের মালিক জানান, ‘কালীগঞ্জের খেজুর রসের গুড় ব্যাপক প্রসিদ্ধ, এই কারণে গুড়ে কাঁচা রসের ঘ্রান পাওয়া যায় অনেক বেশি। এ কারণে বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছে আমাদের এলাকার গুড়ের অনেক সুনাম রয়েছে। তাছাড়া শীত মৌসুমে গুড় দিয়ে অনেক পিঠা তৈরি হয় বাসা বাড়িতে। শীত কালে কেনা গুড় ব্যবসায়ীরা গুদামজাত করে রেখে সারা বছর বিক্রি করে থাকেন। ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ শহরের নীমতলা স্ট্যান্ডে প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার ও সোমবার গুড়ের হাট বসে খুবই জমজমাট ভাবে যা াণ্য কোন স্থানে এমন গুড়ের হাট বসে না। এই হাটে ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার গুড় উৎপাদক কৃষক গুড় নিয়ে আসেন বেশি দাম পাবার আশায়। এ জেলায় কয়েক লক্ষ খেজুরের গাছ রয়েছে বিভিন্ন গ্রামের কৃষকদের। তবে ইটভাটার কারণে স্থানীয়ভাবে প্রতিদিনই খেজুরের গাছ হারিয়ে যাচ্ছে, ইটভাটা মালিকরা বেশি মুল্য দিয়ে খেজুর গাছ কিনে নিয়ে তাদের ভাটায় বিক্রি করছে। তবে কৃষি অফিসের মাঠ পর্যায়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কৃষকদের খেজুর গাছ রোপন করার জন্য প্রতিবছর ব্যাপক হারে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। অনেক কৃষক বানিজ্যি ভাবে খেজুর রস ও গুড় পাবার আশায় বানিজ্যিক ভাবে খেজুর বাগান করেছেন। বর্তমানে খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় ঝিনাইদহ ৬ উপজেলায় এই ঐতিহ্যবাহী গুড়ের হাটের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংকিত হয়ে পড়েছে গুড় ব্যাবসায়ীরা। যেহেতু এলাকায় খেজুর বাগান ক্রমান্বয়ে কম হয়ে আসছে। ফলে গুড় ও রস উৎপাদন কম হবে এমন টা আশা করছে অনেকেই। এবছর রসও গুড়ের দাম অনেকটাই বেশি বলে কৃষকরা ও ব্যবসায়িরা বলছেন, বাজারের অসা মাত্রই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। কৃষকরা বলছেন গুড়ের ও রসের ভাড়ের দাম অনেক বেশি এবং গুড় তৈরির জালানি তেমন একটা পাওয়া যাচ্ছে না। কৃষকরা গুড় তৈরি করে আখের পাতাম বাষের পাতা, আম গাছের পাতা, পাটখড়ি দিয়ে, কিন্তু আড়ের মত রস জালানোর তেমন ভাতা পাওয়া যায় না। অপরদিকে এক শ্রেনির অসাধু কৃষক ও চাষিরা গুড় তৈরি করার সময় বিভিন্ন কেমিক্যান, ফিটকেরি,রং ও চিনিসহ বিভিন্ন কেমিকেল মিশিয়ে গুড়ের রং সুন্দর করে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে থাকে বেশি পাবার আশায়। এ ব্যাপারে বিভিন্ন গাছিদের খেজুরগাছ লাগানো ও পরিচর্যার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদানে সরকারি কৃষি কর্মকর্তাদের কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার আহবান জানিয়েছে বিভিন্ন এলাকার সচেতনমহল সমাজ ও ব্যবসায়ীরা।