খেজুর পরিবেশবান্ধব, স্থানসাশ্রয়ী একটি বৃক্ষ প্রজাতি। এ প্রজাতি দুর্যোগ প্রতিরোধী বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। খেজুর রস ও গুড় বিক্রি করে খামারির আর্থিক লাভ ও স্বাবলম্বী হওয়ার দৃষ্টান্ত বেশ সুপ্রাচীন। গ্রামীণ অর্থনীতি এবং মৌসুমি কর্মসংস্থানে খেজুর গাছের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে শীতকালে বাংলাদেশের সর্বত্রই খেজুর রস, খেজুর গুড় দারিদ্র্য বিমোচনসহ বাঙালি সাংস্কৃতিতে রসঘন আমেজ লক্ষ করা যায়। কুষ্টিয়া জেলায় বছরে গড়ে প্রায় তিন হাজার মেট্রিক টন গুড়-পাটালি উৎপাদিত হয়। জেলায় মৌসুমে রস, গুড় ও পাটালির বাণিজ্য হয় ১০কোটি টাকার বেশি। কুষ্টিয়া সাংস্কৃতিক যশ, খেজুরের রস’ আবহমানকাল ধরে চলে আসা এই প্রবাদটি কুষ্টিয়ার ক্ষেত্রে আজও প্রাসঙ্গিক। খেজুরের রসে গলা ভেজাননি এমন বাঙালি কমই আছেন। খেজুরের এই রস দিয়ে তৈরি গুড়-পাটালি ছাড়া শীতকালটা যেন জমে না। গুড়-পাটালি দিয়ে তৈরি পিঠাপুলি-পায়েসের নাম শুনলেই জিবে পানি আসে। এই খেজুরের গুড় উৎপাদন এখন বাণিজ্যিক রূপ পাচ্ছে। আবার সনাতন বাজারব্যবস্থার বাইরে খেজুরের গুড়ের অনলাইন বাণিজ্যও হচ্ছে। খেজুরের গুড়ের পিঠাপুলি-পায়েস দেশের শত বছরের ঐতিহ্য।
বৃক্ষ পরিবেশ প্রকৃতি :
বাংলাদেশের মাটি ও কোমল প্রকৃতি খেজুর গাছ বেড়ে ওঠার জন্য বেশ উপযোগী। রাস্তা, বাঁধ, পুকুর পাড়, খেতের আইল এবং আবাদি জমিতে এ বৃক্ষ বেশ ভালো জন্মে। তবে নদীর তীর, আংশিক লবণাক্ত এলাকা, বরেন্দ্র এলাকাসহ চরাঞ্চলেও জন্মে। বাংলাদেশের সব জেলা বিশেষ করে বৃহত্তর যশোর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও নাটোর অঞ্চলে খেজুর গাছ বিজ্ঞানভিত্তিক চাষ করা হয়। কুষ্টিয়া, যশোর ও ফরিদপুর দেশের সর্বাধিক খেজুর রস ও খেজুর গুড় উৎপন্ন অঞ্চল।
বৈজ্ঞানিক পরিচয় ও বিস্তৃৃতি :
খেজুর বৃক্ষ একবীজপত্রী আবৃতবীজী উদ্ভিদ। ইংরেজি নাম Wild Date Palm, Silver Date Palm, Indian Wild Palm, আঞ্চলিক নাম খাজুর, খেজুর ও খাইজুর। উদ্ভিদ তাত্ত্বিক পরিচয়চযড়বহরী Phoenix sylvestris (Roxb.) এবং অ্যারাসি (Arecaceae) বা তালগোত্রের সদস্য। এ পরিবারের একটি গণ phoenix, এই গণের অন্য কয়েকটি চেনা গাছ খুদি খেজুর (Phoenix acaulis) ও হেতাল (Phoenix paludosa)।
খেজুর বৃক্ষস্বরূপ :
শাখা-প্রশাখাবিহীন একক কা-যুক্ত ব্যতিক্রমধর্মী খেজুর গাছ। কা-টি সরল ও গোলাকার। একটি কা-ই একাকী বেড়ে ওঠে এমন দৃশ্য বৃক্ষের ক্ষেত্রে খুব কম দেখা যায়। গাছের ট্রাংক বেশ মজবুত ও গোলগাল। কা-ের শীর্ষভাগ যা সদা পত্র শোভিত লাবনি মাথি বেশ দৃষ্টিনন্দন। রস আহরণের জন্য খেজুর গাছ বছরে নূন্যতম একবার কাটা হয় এবং গোলগাল রাখা প্রয়োজন হয়। শীত ঋতুতে উদ্ভিদ জগতে এ নেমে আসে এক প্রাণহীন রসহীন বিবর্ণতার ছায়া তখন খেজুর গাছ রসের বারতা নিয়ে আসে। ফাগুনে প্রকৃতিতে খেজুর ফুল ফোটে। প্রকৃতির দান এর ফুল বিন্যাস যা মানুষকে আকৃষ্ট করে। কুয়াশার চাদরে ঢাকা শীতঋতুতে খেজুুরমাথিতে মুচি (পুষ্পমঞ্জরি) আসে। খেজুর ফুল ভিন্নবাসী, পুষ্পমঞ্জরি দেখে পুরুষ ও স্ত্রী গাছ চিহ্নিত করা যায়। শুধু স্ত্রী গাছে ফুল ও ফল ধরে পুং গাছে নয়। পুং পুষ্পমঞ্জরি খাটো, স্ত্রী পুষ্পমঞ্জরি লম্বা ও ফুলের বর্ণ সাদা। খেজুর ফুল শক্ত মোচা থেকে বের হয়। মোচা থেকে ফুল ফোটা এক অপার মহিমা, মনে হয় কোথা থেকে কোন ফুলপরি কণ্টাকীর্ণ গাছের মাথিতে মন্ত্র দিয়ে ফুল ফুটিয়েছে। খেজুরের মুচিতে এক ধরনের সাদা উপাদান, যা পরাগরেণুর সুবাস।
বহু গুণে গুণী খেজুর গাছ :
খেজুরের বহুল ব্যবহার নিয়ে বর্ণনার শেষ নেই। রস দিয়ে নানা রকম পিঠা, পায়েস, গুড়, কুটির শিল্প, আয় ও কর্মসংস্থান হয়। সার্বিক বিবেচনায় খেজুর সমধিক গুরুত্ববহ একটি প্রজাতি।
খেজুর ফলের পুষ্টি উপাদান : এই উদ্ভিদ মানবদেহের জন্য উপকারী বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান সমৃদ্ধ। খেজুর ফল ফাইবার ও ভিটামিন সমৃদ্ধ। খাদ্যোপযোগী প্রতি ১০০ গ্রাম শুকনা খেজুর ফলের মধ্যে ১৮.০ গ্রাম জলীয় অংশ, মোট খনিজ পদার্থ ১.৭ গ্রাম, ৩.৯ গ্রাম আঁশ, ৩২৪ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি, ২.২ গ্রাম আমিষ, ০.৬ গ্রাম চর্বি, ৭৭.৫ গ্রাম শর্করা, ৬৩ মি. গ্রাম ক্যালসিয়াম, ৭.৩ মিলিগ্রাম লৌহ, ০.১০ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-১, ০.০৪ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-২ এবং অল্প পরিমাণ ভিটামিন সি বিদ্যমান থাকে। প্রচলিত খাদ্য হিসেবে খেজুর রস বেশ সস্তা, পুষ্টিকর এবং উপাদেয়। খেজুর রসে অ্যাসপারটিক এসিড, নাইট্রিক অ্যাসিড এবং থায়ামিন বিদ্যমান।
খেজুর রস :
শীত ঋতু এলেই গ্রামীণ সংস্কৃতিতে খেজুর রসের কথা মনে পড়ে। ফোঁটা ফোঁটা সঞ্চিত রস নির্গত হবে চোং দিয়ে। হাঁড়িতে জমে রসের ফোঁটা। এভাবে একটি গাছ দৈনিক গড়ে ৫-৬ লিটার রস দিয়ে থাক। কথিত আছে ‘খালি কলসি রেখে দিলে ভরে যায় রসে, সেই রসে দিয়ে জ¦াল মন ভরে সুবাসে’। আবার গাভীর সাথে তুলনায় বলা হয় ‘মাইট্যা গোয়াল কাঠের গাই-বাছুর ছাড়া দুধ পাই’। কাকডাকা ভোরে খেজুরের রস, মন মাতানো ঘ্রাণ শহরে বিরল। শীতের সাকালে খেজুর রস, মিষ্টি রোদ, কৃষক-কৃষাণির হাসি দারুণ প্রাণশক্তি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর হতে জানা যায়, কুষ্টিয়া খেজুরের গুড় ও পাটালির বাণিজ্য ক্রমে সম্প্রসারিত হচ্ছে। প্রচলিত বাজারব্যবস্থার বাইরে খেজুরের গুড়ের অনলাইন বাণিজ্যও হচ্ছে। জেলায় বিশুদ্ধ ও নিরাপদ গুড়-পাটালি উৎপাদন বেড়েছে। এতে গাছিরা লাভবান হচ্ছেন। বিশুদ্ধ ও নিরাপদ গুড়-পাটালি উৎপাদনে তাঁরা গাছিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
‘গাছ তোলা’ :
গাছিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসে খেজুরের গাছ তোলা (গাছের উপরিভাগ চেঁছে পরিষ্কার করা) হয়। কয়েক দিন রেখে দিয়ে গাছের তোলা অংশ শুকানো হয়। অগ্রহায়ণের শেষে খেজুরগাছ চেঁছে ওপরের দিকে দুটি চোখ কাটা হয়। নিচের দিকে বাঁশের নল বা নলি পোঁতা হয়। দুই চোখের মাঝ থেকে কেটে নল বা নলি পর্যন্ত একটি সরু পথ তৈরি করা হয়। নল বা নলির নিচে দড়ি দিয়ে মাটির তৈরি ভাঁড় ঝোলানো হয়। প্রতিবার চোখ দুটি কাটা হয়। চোখ থেকে পথ দিয়ে বেয়ে রস মাটির ভাঁড়ে এসে জমা হয়। গাছিরা জানান, খেজুরের রস বিক্রি হয় ৭ থেকে ১০ কেজি ওজনের প্রতি মাটির ভাঁড় ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়, গুড় বিক্রি হয় ২০০ টাকা এবং পাটালি বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি দরে। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার দেড়ীপাড়া, মাছপাড়া, বাখইল, আসাননগর, আব্দালপুর ঘুরে পরিশেষে উজানগ্রাম গ্রামের গাছি আফাজ আলী (৫৮)। তিনি বলেন, ‘আমি এবার ৬০টি গাছ কাটছি। প্রতিদিন পর্যায়ক্রমে ২০টি করে গাছ কাটব। প্রতিদিন ১০-১২ ভাঁড় রস হবে। গত বছর কাঁচা রস ১৫০ টাকা করে বিক্রি করেছি। একদিন গাছ কাটলে যে রস পাওয়া যায়, তা দিয়ে আমার আট কেজি গুড়-পাটালি হয়। গুড় ২০০ টাকা করে বিক্রি করেছি। পাটালি প্রথমে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি বিক্রি করেছি।’
রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরি :
গাছ কাটার পরের দিন ভোরবেলায় খেজুরগাছ থেকে রসভর্তি মাটির ভাঁড় নামিয়ে আনেন গাছি। পাঁচ দিন বিরতি দিয়ে আবার গাছ কাটা হয়। একবার গাছ কাটলে তিন দিন রস পাওয়া যায়। প্রথম দিনের রসকে বলে ‘জিড়ানকাট’। এ রস জ¦াল (তাপ) দিয়ে তৈরি করা হয় ভালো পাটালি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে রসের পরিমাণ কমতে থাকে। দ্বিতীয় দিনের রসকে ‘দোকাট’ ও তৃতীয় দিনের রসকে ‘তেকাট’ বলে। এই রস দিয়ে ঝোল গুড় বা চিটাগুড় তৈরি হয়। মাটির তৈরি পাত্র ‘নানদা’ অথবা টিনের তৈরি ‘তাফালে’ রস রেখে জ¦াল দিয়ে গুড় তৈরি করা হয়। তবে পাটালি তৈরি করতে রস অনেকক্ষণ জ¦াল দিতে হয়। গুড় গাঢ় হলে উনুন থেকে নামিয়ে নানদা বা তাফালের একপাশে কিছুটা গুড় নিয়ে ছোট করে কাটা খেজুরপাতার ডাঁটা দিয়ে গুড় ঘষে সাদা করা হয়। একে ‘বীজ মারা’ বলে। এরপর বীজ গুড় অবশিষ্ট গুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। শেষে পলিথিন অথবা কলার পাতার ওপর গুড় ঢেলে শুকিয়ে পাটালি তৈরি করা হয়।
লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য:
মনমাতানো ঘ্রাণ আর রসনা তৃপ্ত করা স্বাদের নলেন গুড়ের জুড়ি নেই। মৌসুমের শুরুতে খেজুরগাছ চেঁছে বাঁশের নল বা নলি পোতা হয়। নলি পোতার পর প্রথমবার সংগ্রহ করা রস থেকে তৈরি গুড়কে ‘নলেন গুড়’ বলে। এই রস কিছুটা নোনতা। অপূর্ব স্বাদ ও মনমাতানো গন্ধ এই নলেন গুড়ে। নলেন গুড় থেকে তৈরি হয় সুস্বাদু সন্দেশ, প্যাড়া সন্দেশ, ক্ষীর-প যশোরে খেজুরের গুড় ও পাটালির বাণিজ্য ক্রমে সম্প্রসারিত হচ্ছে। গাছিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
অনলাইনে বেচাকেনা:
২০১৮ সাল থেকে কুষ্টিয়া যশোরের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অনলাইনে গুড়-পাটালি বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। এতে বাজার কিছুটা সম্প্রসারণ হচ্ছে। এ বিষয়ে উদ্যোক্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, সদর উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের ২০০ জন প্রশিক্ষিত গাছির কাছ থেকে ভেজালমুক্ত গুড় ও পাটালি কেনা হচ্ছে। গত মৌসুমে তাঁরা প্রায় ১২ হাজার কেজি গুড় ও পাটালি অনলাইনে বিক্রি করেছেন। এ মৌসুমে তাঁদের ২০ হাজার কেজি গুড় ও পাটালি বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।