দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণের আর মাত্র দুইদিন বাকি। শেষ সময়ে পটুয়াখালী জেলার ৪টি আসনের মধ্যে ৩টি আসনে জমে উঠেছে প্রচার- প্রচারণা। ১ টিতে নৌকা নির্ভার প্রার্থী নিশ্চিত প্রায়। ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন হাতেগোনা প্রার্থীরা। এলাকায় এলাকায় চলছে উঠান বৈঠক পথসভা। এ জেলার চারটি আসনের পটুয়াখালী-১ আসন জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। বাকি তিনটি আসনের পটুয়াখালী-২ আসনে দশম বারের মত নৌকা প্রতীক নিয়ে অপ্রতিদ্বন্দি হয়েছেন সাবেক চীফ হুইপ আ.স.ম ফিরোজ। এ আসনে কোনো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় অষ্টম বারের মত নিশ্চিত জয়ের পথে হাটলেও পটুয়াখালী-৩ ও ৪ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীর চাপে নাজেহাল নৌকার দুই প্রার্থী। পটুয়াখালী-৩ আসনে নৌকার প্রার্থী ও বর্তমান এমপি এসএম শাহজাদা সাজুর প্রতিপক্ষ নৌকা বঞ্চিত বিজিবির সাবেক মহা পরিচালক লে. জেনারেল অব: আবুল হোসেন। আর পটুয়াখালী-৪ আসনে বর্তমান এমপি মহিবুবুর রহমান মুহিবের প্রতিপক্ষ সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদার। এ দুই আসনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ায় নৌকার জয় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ কারণে প্রায়ই ঘটছে সংঘাত সংঘর্ষ আর মামলার ঘটনা।
পটুয়াখালী-১ ঃ
পটুয়াখালী সদর, দুমকি ও মির্জাগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত পটুয়াখালী-১ আসন। এ আসনে ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৭৩ হাজার ৩৭১ জন। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাড. আফজাল হোসেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তবে আসনটি জাতীয়পার্টির কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার কে ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। এ কারণে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন আজফাল হোসেন। এছাড়াও বাংলাদেশ কংগ্রেস (ডাব) মার্কার নাসির উদ্দিন তালুকদার, তরিকত ফেডারেশনের ফুলের মালা নিয়ে মো. খলিলুর রহমান, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি - এনপিপির আম প্রতীক নিয়ে মো. নজরুল ইসলাম, জাসদের মশাল প্রতীক নিয়ে মহিউদ্দিন মামুন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী না থাকায় দলের সভাপতি সহ মুল সারির নেতাকর্মীরা লাঙ্গলের প্রচার-প্রচারণায় মেতে উঠেছেন। শেষ সময়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের লাঙ্গলের প্রচারনায় ধরে রাখতে জোর চেষ্টা ও নানা কৌশল চালাচ্ছেন রুহুল আমিন হাওলাদার। তবে যুবলীগ আর ছাত্রলীগ নিয়ে আফজাল হোসেন বাংলাদেশ কংগ্রেস (ডাব) মার্কার নাসির উদ্দিন তালুকদারের পক্ষে কখনো প্রকাশ্য আবার কখনো গোপনে প্রচারনা চালানোর অভিযোগ করেছেন জাপার প্রার্থী রুহুল আমিন হাওলাদার।
পটুয়াখালী-২ ঃ
২লাখ ৯৩ হাজার ২২ ভোটার নিয়ে একটি মাত্র উপজেলা বাউফল নিয়ে গঠিত পটুয়াখালী-২ আসন। এ আসনটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনতার পর থেকে এখানে নৌকার জয়জয়কার। ১৯৭৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নয়বার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান সাবেক চীফ হুইপ আ.স.ম ফিরোজ। যার মধ্যে ৭ বার নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৯৬ সালে দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি। আর ২০০১ সালে বিএনপির শাহিদুল আলম তালুকদার জয়ী হন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আ.স.ম ফিরোজকে মনোনয়ন দেয়া হয়। এ আসনে আ.স.ম ফিরোজের সাথে স্থানীয় পৌর মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক জিয়াউল হক এবং উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব হাওলাদারের সাথে বিরোধ চলছে। এ বিরোধের জেরে তিন পক্ষের অনুসারীদের মধ্যে অসংখ্য বার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। হতাহত হয় অনেকে। যার রেশ পড়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে। আ.স.ম ফিরোজের বিপরীতে দলীয় মনোনয়ন চান ১২ জন। যার মধ্যে পৌর মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল হক জুয়েল, উপজেলা চেয়ারম্যান মোতালেব হাওলাদার, ব্যবসায়ী হাসিব আলম ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান এস. এম ফিরোজ আলম একজোট হয়ে নৌকার মনোনয়ন চান। কিন্তু দল নৗকার কাঙ্গারি হিসেবে আ স ম ফিরোজকেই বেছে নেয়। ফলে মনোনয়ন বঞ্চিত হাসিব আলমকে স্বতন্ত্র প্রার্থী করে মাঠে নামেন ফিরোজ বিরোধী জোট। তবে হাসিব আলম নৌকার সমর্থন জানিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। এতে বিষাদের কালো ছায়া নেমে আসে ফিরোজ বিরোধী শিবিরে। আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী না থাকলেও নৌকার সাথে লড়ছেন জাতীয় পার্টির (লাঙ্গল) মহসীন হাওলাদার, বিএনএফের (টেলিভিশন) জুবায়ের হোসেন রাসেল ও তৃণমূল বিএনপির মাহবুবুর আলম। তবে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় অষ্টম বারের মত জয় নিশ্চিত আ.স.ম ফিরোজ ভোটার উপস্থিতির চ্যালেঞ্জ নিয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। এলাকায় এলাকায় চলছে উঠান বৈঠক, পথসভা ও গণসংযোগ।
পটুয়াখালী-৩:
দশমিনা ও গলাচিপা উপজেলা নিয়ে গঠিত পটুয়াখালী-৩ আসন। এ আসনে ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৫২ হাজার ২৬৭ জন। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান বর্তমান এমপি ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদার ভাগিনা এস.এম শাহজাদা। একাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রথম বার এমপি নির্বাচিত হন শাহজাদা। তখন থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে বিরোধে জড়ান শাহজাদা। সেই বিরোধের কারণেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে চাপে পড়েছেন তিনি। এ আসনে আওয়ামী লীগের একাংশের সমর্থন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক লে. জেনারেল অব: আবুল হোসেনের ঈগল প্রতীকে। এতে শাহজাদার নৌকার পালে ভাঁটা পড়েছে। নৌকার জয় প্রধান বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে স্বতন্ত্র ঈগল। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সহ প্রথম সারির নেতারা নৌকার বিরুদ্ধে নেমেছেন একাট্টা হয়ে।
এছাড়াও এ আসনে প্রার্থী হয়েছেন ন্যাশনাল পিপলস পার্টি- এনপিপির (আম) ছাইফুর রহমান, ন্যাশনালিষ্ট ফ্রন্ট - বিএনএফের (টেলিভিশন) এ ওয়াই এম কামরুল ইসলাম, জাতীয় পার্টির (লাঙ্গল) নজরুল ইসলাম ও বাংলাদেশ সুপ্রীম পার্টির (একতারা) নূরে আলম।
পটুয়াখালী-৪ ঃ
কলাপাড়া ও রাঙ্গাবালী উপজেলা নিয়ে গঠিত পটুয়াখালী-৪ আসন। এ আসনে ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৯০ হাজার ৬৯২ জন। শেষ সময়ে ভোটের মাঠ সরগরম। জেলার গুরুত্বপূর্ণ এই আসনে সরকারের মেগা প্রকল্পে ভরপুর। তাই এখানের সংসদ সদস্যের রয়েছে বেশ চাহিদা। যার ফলে সংসদীয় এই আসনে ভোটযুদ্ধ চলছে ধুমছে। এ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত বর্তমান এমপি মহিববুর রহমান (মুহিব), আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদার সহ ৬ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বর্তমান এমপি মুহিবুর রহমান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান সম্পর্কে মামাতো ফুফাতো ভাই হলেও ভোটের মাঠে কেউ কাউকে ছাড়তে নারাজ। দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে প্রচার- প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা। প্রায়ই ঘটছে দু’পক্ষের সমর্থকের মধ্যে সংঘর্ষ-রক্তপাতের ঘটনা। আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ ঈগলের মধ্যে অবস্থান নেওয়ায় নৌকা উজান বেয়ে চলছে। নৌকার জয়ে প্রধান বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে কলাপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহবুবুর রহমানের ঈগল প্রতীক। তবে ভোটাররা বলেছেন- গত ৫ বছরে এমপি মহিববুর দৃশ্যমান কোন উন্নয়ন করতে পারেনি। আর মাহাবুবুর রহমান যে উন্নয়ন করেছে তার জন্য এই আসনের মানুষ কৃতজ্ঞ।
এছাড়াও ভোটযুদ্ধে নিরবে কাজ করছেন আওয়ামী লীগ নেতা ও ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল ইসলাম লিটন। তিনি সাবেক প্রয়াত সংসদ সদস্য আনোয়ার উল ইসলামের ছেলে। তিনিও রয়েছেন আলোচনার শীর্ষে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে মোট ৬ জন প্রার্থীর মধ্যে নৌকা, ঈগল ও ট্রাক প্রতীকের প্রার্থীরা মাঠে সরব থাকলেও খোঁজ নেই জাতীয় পার্টির (লাঙ্গল) মন্নান হাওলাদার, বাংলাদেশ কংগ্রেস'র (ডাব) জাহাঙ্গীর হোসাইন ও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের (মশাল) বিশ্বাস শিহাব পারভেজ মিঠুর।