দেশ এখন ডিজিটাল হলেও ক্রসিংগুলো ডিজিটাল হচ্ছে না। রেলওয়ের লেভেল ক্রসিং এখন হয়ে পড়েছে মানুষ খেকো। সারাদেশে হাজার হাজার অবৈধ ও বৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে ঝরছে তাজা প্রাণ। পঙ্গুত্ববরণ করছেন অনেকে। দিন দিন নিরাপদ বাহনের তকমা হারাচ্ছে রেল। বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের বৈধ ও অবৈধ মিলে অন্তত ৮০ শতাংশ লেভেল ক্রসিং অরক্ষিত। ওসব লেভেল ক্রসিংয়ে গত ২০ বছরে (২০০৮-২০২০) ৩১২টি দুর্ঘটনায় ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩০ জন। অপ্রতিটি দুর্ঘটনার পরই তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো তদন্তই আলোর মুখ দেখে না। ক্ষমতায় টিকে থাকা কিংবা ক্ষমতা যাওয়ার জন্য যত ফন্দি করা হয় তার ছিটেফোঁটাও যদি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করা হতো, তাহলে এভাবে লেভেল ক্রসিংয়ে মানুষের জীবন বিপন্ন হতো না।
লেভেল ক্রসিং হচ্ছে রেললাইনের উপর দিয়ে যাওয়া সড়কের সংযোগস্থল। কিছু সংযোগস্থল রক্ষিত (পাহারাদার আছে)। আর কিছু অরক্ষিত (পাহারাদার নেই)। রেলপথে মোট ক্রসিং আছে দুই হাজার ৮৫৬টি। এর মধ্যে প্রায় এক হাজার ৩৬১টির অনুমোদন নেই। আর এক হাজার ৪৯৫টি বৈধ ক্রসিংয়ের মধ্যে ৬৩২টির গেটম্যান নেই। অবৈধ ক্রসিংয়ের বেশির ভাগ রাস্তা-ই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) ও ইউনিয়ন পরিষদের। বিগত এক যুগে রেলওয়েতে এক লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও লেভেল ক্রসিংগুলোকে নিরাপদ করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যে কারণে একটি দুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে আর একটি দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে ডুবতে বসেছে রেলের সুনাম। রেলের ভিতরে বাইরে সবখানেই যেন সমস্যা। অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ছোট একটি সতর্কীকরণ নোটিশ টাঙিয়ে কর্তৃপক্ষ দায় সারে। কিন্তু একবারওভাবে না এটি ক্রসিং নামের মৃত্যুফাঁদ। যখনই দুর্ঘটনা ঘটে তখন দায়ী ব্যক্তিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু তদন্ত কমিটির রিপোর্টের সুপারিশ অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। কারণ ঘটনার মূলে যারা বসে আছে, তারা সবাই হয় স্থানীয় রাজনীতিতে দলীয়ভাবে প্রভাবশালী না হয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। ফলে রেলের বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, যাত্রী ভোগান্তি কিংবা দুর্ঘটনা কমেনি। উল্টো রেল দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। কোনোভাবেই যেন মৃত্যুর মিছিল ঠেকানো যাচ্ছে না। রেল খাতে প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ করা হলেও রেলের সামগ্রিক উন্নয়নে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। তাই রেলের বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি লেভেল ক্রসিংয়ের ঝুঁকি নিরসন এবং যাত্রীসেবার মান উন্নয়নেও পদক্ষেপ নিতে হবে। রেলে বিদ্যমান দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা দূর করার পদক্ষেপ নেওয়া না হলে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হবে না।