নানা ঘটনা আলোচনা সমালোচনা, সুনাম খ্যাতি, সুখ দু:খ, হাঁসি কান্নার মধ্যেই চলে গেছে সরাইলের মানুষের ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ। গত একটি বছর সরাইলের আইন-শৃঙ্খলা খুব ভাল ছিল রেকর্ডে তেমনটা বলে না। আবার খুব খারাপও ছিল না। ৩৬৫ দিনে সরাইলে ২৮ নারী পুরূষ ও যুবতীর আত্মহত্যা ও ১০ খুনের ঘটনা মোটেও কাম্য ছিল না কারো। পারিবারিক কলহ, মাদকাসক্তি, যৌতুক ও বাল্যবিয়ে আত্মহত্যার জন্য অনেকাংশে দায়ী। হত্যাকান্ডের পেছনে গোষ্ঠীগত দ্বন্ধ, আধিপত্য বিস্তার, পরকিয়া ও প্রেম ভালবাসার বিয়েকে দায়ী করছেন অনেকেই। মোট ২৩২ টি মামলায় আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে মাত্র ৪২০ জন। গড়ে প্রতি মামলায় গ্রেপ্তার ২ জনেরও কম। ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে ৯টি। এরমধ্যে শিশু ধর্ষণের অভিযোগে মামলার সংখ্যা ৫টি। বিজিবি, র্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহায়তায় মাদক দ্রব্য উদ্ধারে পিছিয়ে নেই সরাইল থানা। ১২ মাসে প্রস্তুতি কালে ৪৯ ডাকাতকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। থানার রেকর্ড ও স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে সরাইলের ৯টি উপজেলায় আত্মহত্যা করেছে মোট ২৮ জন। এর মধ্যে পুরূষ ৩ জন, মহিলা ৪ জন, যুবক ৯ জন ও যুবতী ১২ জন। সরাইলে যুবতী ও কিশোরী মেয়েদের আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হিসেবে বাল্যবিয়েকে দায়ী করছেন অনেকেই। যুক্তি হিসেবে সামনে চলে আসে কিশোরী বা শিশু বয়সে মেয়েটি বুঝেই না সংসার ও স্বামী কী। কারণ বয়স ১৮ বছর না হলে মস্তিস্ক পরিপক্ক হয় না। এরা তখন শিশু সুলভ আচরণ করে সর্বদা। তাই দায়িত্ববোধ জাগ্রত হওয়ার আগেই সংসারের বোঁজা তুলে দেয়া শিশুটির হাতে। ফলে সামান্য সমস্যায় রাগান্বিত হয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। অতিরিক্ত চাপ ও মানসিক যন্ত্রণায় একসময় ওই কিশোরী বা শিশুরা মনে করে মৃত্যুটাই মনে হয় সবচেয়ে বড় সমাধান। তখনই যেকোন উপায় অবলম্বন করে দুনিয়া ছাড়ার জন্য পাগল হয়ে যায়। তাদের ধারণা আত্মহত্যা করলেই মনে হয় সকল সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব। তখনই তারা আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেয়। অনেকে আবার আত্মহত্যার জন্য বাল্যবিয়ের পাশাপাশি পারিবারিক অভাব অনটন, প্রেমে ব্যর্থ, স্বামী বা স্ত্রীর পরকিয়া সম্পর্ককে ঘিরে কলহ ইত্যাদিকে দায়ী করেন। আলোচিত আত্মহত্যা: জানুয়ারি মাসের ১৮ তারিখে একই ইউনিয়নের বিশুতারা গ্রামের আশিক মিয়ার মেয়ে জোনাকি (১৪)। একই গ্রামের মাহিদুল (১৮) নামের বখাটের উত্যক্তের প্রতিবাদে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে জোনাকি। মাদ্রাসা ছাত্রী ইভা আক্তার। বয়স মাত্র ১৪ বছর। বাড়ি নোয়াগাঁও ইউনিয়নের কাটানিশার গ্রামে। আপন মামাত ভাই ফারূকের (২০) সাথে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। বিষয়টি জানতে পেরে ফারূকের মা ইভাকে তিরস্কার ও অপমান করেন। সহ্য করতে পারেনি ইভা। ২৩ সালের ১লা মে রাতে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে অপমানের প্রতিবাদ জানায়। হয়েছে মামলা। ঘটনাটি বেশ আলোচনা সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। এমন সব কারণে একই কায়দায় সরাইলে ঘটেছে আত্মহত্যার ঘটনা। আবার অনেক আত্মহত্যার পেছনে আপত্তিজনক ও চাঞ্চল্যকর তথ্যও পাওয়া গেছে। কিন্তু আইনগত অভিভাবক বা উত্তরাধিকারীদের ধামাচামার কারণে চাঞ্চল্য গুলো আলোর মুখ দেখেনি। আলোচিত খুন/হত্যা: শাহিদা (৩০) নামের মেয়েটিকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল আল-আমিন (৩৭)। আর সেই ভালবাসার মানুষটির গাঁয়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে মধ্যযোগিয় কায়দায় নির্মম ভাবে পুঁড়িয়ে হত্যা করেছে স্বামী। গত বছরের ১১ ডিসেম্বর উপজেলার কালীকচ্ছ ইউনিয়নের মধ্যপাড়ায় স্বামীর বাড়িতে এই ঘটনাটি ঘটে। যৌতুক ও পরকিয়ার কারণেই এই হত্যাকান্ড ঘটেছে বলে জানিয়েছেন পরিবার। এই ঘটনাটি সরাইলবাসীর মনে বেশ দাগ কেটেছে। থানায় জিডি করেও জীবন বাঁচাতে পারলেন না সরাইলের পাকশিমুল ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের নৌকা ব্যবসায়ি চান্দালীর ছেলে সালিসকারক হাফিজ উদ্দিন (৪৭)। তার অপরাধ সালিস সভায় ন্যায় কথা বলা। গত বছরের ৪ আগস্ট শুক্রবার বিকেলে একই গ্রামের প্রয়াত আমিন মিয়ার ছেলে রায়হানের নেতৃত্বে ৫-৬ জন যুবক ধারালো অস্ত্র নিয়ে হাফিজের উপর হামলা চালিয়ে বুকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। এই হত্যাকান্ডটি শুধু সরাইল নয়, গোটা জেলায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। ১৪ এপ্রিল শুক্রবার রাতে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরাইল-নাসিরনগর সড়কের কালিকচ্ছ বাজারে সূর্যকান্দি ও ধর্মতীর্থ গ্রামের কয়েকশত দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। হামলা পাল্টা হামলায় সংঘর্ষটি রণক্ষেত্রে রূপ নেয়। পুলিশ এসে ৫৬ রাউন্ড রাবার বুলেট ও ৬ রাউন্ড টিয়ারসেল ছুঁড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এরইমধ্যে কলেজ ছাত্র ফয়সাল ছুররা গুলির আঘাতে মারা যায়। তবে পুলিশের বক্তব্য প্রতিপক্ষের ককটেল বিস্ফোরণে নিহত হয়েছে ফয়সাল। ফয়সাল খুনের দায় পুলিশের নাকি প্রতিপক্ষের? তা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হয়েছে গোটা দেশে। তদন্তও হয়েছে একাধিকবার। প্রথমে ফয়সালের চাচা বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেছেন। আবার কয়েকদিন পর ফয়সালের পিতা বাদী হয়ে মামলা করেছেন। পুলিশ বাদী হয়েও মামলা করেছেন। এই ঘটনায় একাধিক মামলায় ওই এলাকার ৪৬৯ জন লোক আসামি হয়েছে। কারাবরণ করেছেন ইউপি চেয়ারম্যান মো. ছায়েদ হোসেন। শুরূতে ঘটনাটি বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলেও সাম্প্রতিক সময়ে একেবারে নিরব। গত বছরের ১২ মে শিশু সন্তান তাজিমের (১০) সামনে তৃতীয় স্ত্রী নয়ন তারাকে (৩৫) দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে স্বামী চান মিয়া মোস্তফা (৪০)। নৃশংষ এই ঘটনাটি ঘটেছে গভীর রাতে সরাইল-নাসিরনগর-লাখাই আঞ্চলিক সড়কের পাশে ধর্মতীর্থ এলাকার আশা ব্রীকস্ মিলে। জায়গা সম্পত্তি, আধিপত্য বিস্তার, অপকর্ম ও অনিয়মে বাঁধা এমনসব কারণেই ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে সরাইলে ১৪-১৫ টি খুন বা হত্যার ঘটনার ঘটেছে। এই রেকর্ডের বাহিরেও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। যেগুলো থানা পর্যন্ত আসেনি। আবার কিছু আত্মহত্যা পাবিবারিক বা সামাজিক ভাবে ধামাচাপা দেয়া হয়েছে। ধর্ষণ: গত বছরের ১৭ অক্টোবর রাতে নাতিন ডেকে প্রতিবন্ধী এক কিশোরীকে (১৮) ধর্ষণের অভিযোগে হামিদ ঠাকুর (৫৮) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছেন সরাইল থানা পুলিশ। হামিদ ঠাকুর সরাইল সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ কুট্রাপাড়ার প্রয়াত আবদার ঠাকুরের ছেলে। এ ঘটনায় একই গ্রামের বাসিন্দা ওই কিশোরীর বাবা হামিদের বিরূদ্ধে থানায় মামলা করেছেন। প্রথম শ্রেণির এক ছাত্রীকে (৬ বছর, ৬ মাস) ধর্ষণের চেষ্টাকালে হাতেনাতে ধরা পড়েছে বিল্লাল মিয়া (৫০) নামের এক ব্যক্তি। ছাত্রীর বাবা বাদী হয়ে গত ৩০ মে সরাইল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে (জোর পূর্বক ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে) ৫ সন্তানের জনক বিল্লাল মিয়ার বিরূদ্ধে মামলা করেছেন। আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছে ওই ছাত্রী। গত বছরের ২৮ মে রোববার দুপুরের দিকে উপজেলার অরূয়াইল ইউনিয়নের রানীদিয়া গ্রামে এই ঘটনা ঘটেছে। সরাইলে ভগ্নিপতি মো. সাইফুলের বিরূদ্ধে (২১) ৯ বছর বয়সের শ্যালিকাকে ধর্ষণ করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। গত বছরের ২৫ মে উপজেলার শাহজাদাপুর গ্রামে মর্মান্তিক এই ঘটনাটি ঘটেছে। বাধ্য হয়ে শ্বশুর জামাইর বিরূদ্ধে ধর্ষণ মামলা দায়ের করেছেন। এর বাহিরেও শিক্ষক কর্তৃক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগে মামলাও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু ছাত্রীর পরিবার দরিদ্র ও দূর্বল হওয়ায় প্রভাবশালীদের চাপে এখন কোনঠাসা। বছর পেরিয়ে গেলেও ধর্ষক গ্রেপ্তার না হওয়ায় এলাকায় বেশ মুখরোচক আলোচনা চলছে। মাদক: সরাইলে মাদকদ্রব্য উদ্ধার ও কারবারিদের গ্রেপ্তারে থানা পুলিশের পাশাপাশি কাজ করেছেন বিজিবি, র্যাব, হাইওয়ে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। গত এক বছরে সরাইলে ৩৩২ কেজি ৫০০ গ্রাম গাঁজা, ৪১৫ বোতল ফেন্সিডিল, ২৭৯৭ পিস ইয়াবা, ৪২ বোতল এস্কফ উদ্ধার করেছে। এসব ঘটনায় সরাইল থানায় মাদক আইনে মামলা হয়েছে ৫৩টি। গ্রেপ্তার করা হয়েছে মোট ৮১ জনকে। সরাইল থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে মোট ৪৯ জন ডাকাতকে গ্রেপ্তার করেছেন। আর মামলা হয়েছে ৫টি। সরাইল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বলেন, উল্লেযোগ্য সংখ্যক নারী ও যুবতীদের আত্মহত্যার অন্যতম কারণ বাল্যবিয়ে। এ ছাড়া ইভটিজিং এর বিষয় গুলো ভয়ে মেয়েরা পরিবার বা কাউকে বলে না। অপরিপক্কতার কারণে আবেগতাড়িত হয়ে এরা অনেক সময় আত্মহত্যা করে। প্রবাসীর স্ত্রীদের শ্বশুর বাড়িতে বনিবনা হয় না। ক্রোধ ক্ষোভ জন্মায়। ফলে দূর্ঘটনা ঘটায়। ক্যারিপোকার ওষুধ ক্রয় বিক্রয়ে আরো সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। কারণ লিকুইড বিষ পান করলে ওয়াশ করলে বেঁচে যায়। কিন্তু ক্যারিপোকার ওষুধ সেবন করলে ওয়াশে কাজ হয় না। আরো সমস্যা হয়। এই সকল বিষয়ে বেশী করে কাউন্সিলিং ও উদ্ভুদ্ধকরণ কার্যক্রম আবশ্যক।