দেশের জালানী তেল প্রতিনিয়ত চোরাপথে পাঁচার হচ্ছে অন্য দেশে। কক্সবাজার থেকে নৌপথে মিয়ানমারে পাঁচার হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানি করা জ্বালানি ও ভোজ্য তেল। মেরিন ড্রাইভ থেকে এক লিটার অকটেন পাঁচারকারীর নৌকায় তুলে দিতে পারলে লাভ মিলছে নগদ ১৬৫ টাকা। কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন সাগর থেকে মিয়ানমার উপকূলে পৌঁছলে সেই অকটেন প্রতি লিটারে লাভ ৩০০ টাকা। বর্তমানে চট্টগ্রামের উপকূল দিয়ে গভীর সাগরপথেও প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে সরাসরি জ্বালানী তেল পাঁচার হচ্ছে। মূলত অনিবন্ধিত নৌযান করে পাঁচার হচ্ছে তেল। তাই ইতোমধ্যে জেলার সকল পেট্রোল পাম্প ও জ্বালানি তেল বিক্রির দোকানে ক্রেতাদের তথ্য সংরক্ষণের নির্দেশনা দেয়ছে জেলা প্রশাসক। বিশ্বের প্রায় সব দেশই এখন জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমন্বয় করে বিক্রি করছে। যখন আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে যাচ্ছে তখন দেশের বাজারেও বাড়ছে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দেশের বাজারেও কমিয়ে আনা হয়। এখন প্রায় প্রত্যেকটি দেশ এভাবে চলছে। এতে তেল পাঁচারের ঝুঁকিটা থাকে না। কিন্তু বাংলাদেশই সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। যার কারণে যখন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যায়, তখন পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় জ্বালানি তেলের দামে ব্যাপক পার্থক্য তৈরি হয়। এতে বাংলাদেশ থেকে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় তেলের পাঁচার বেড়ে যায়। বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে দেশের জ্বালানি ও ভোজ্যতেলের বাজারেও রয়েছে উত্তাপ। এ নিয়ে সংকট কাটাতে সরকার যখন নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে, তখন সীমান্তের ফাঁক গলে কক্সবাজারের উপকূল দিয়ে মিয়ানমারে পাঁচার হয়ে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানি করা জ্বালানি ও ভোজ্যতেল। কক্সবাজারের ইয়াবা পাঁচারের রুট ব্যবহার করে দেশ থেকে প্রচার হছে জ্বালানি তেল। ফলে ইয়াবার পাঁচারের ট্রানজিট রুটে পরিণত হচ্ছে তেল পাঁচারের ট্রানজিটে।মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত ২৭১ কিলোমিটারের। বিস্তৃত এ সীমান্তপথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে পাঁচার হয় জ্বালানি তেল। কক্সবাজারের কমপক্ষে ২২টি পয়েন্ট ব্যবহার করে নৌকা ও ট্রলারে পাঁচার হচ্ছে এসব তেল ও পণ্য। কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক, নুনিয়ারছড়া, মাঝের ঘাট, খুরুশকুল, চৌফদণ্ডী, কলাতলী, দরিয়ানগর, হিমছড়ি, ইনানী, সোনাপাড়া, টেকনাফের শাপলাপুর, লম্বরী, মহেশখালীয়াপাড়া, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলার সমুদ্র উপকূল ব্যবহার করে তা পাঁচার করে যাচ্ছে সিন্ডিকেট সদস্যরা। যাদের একটি তালিকাও ইতোমধ্যে তৈরি করেছে প্রশাসন। তালিকায় জ্বালানি ও ভোজ্য তেলের ডিলার প্রতিষ্ঠানের মালিক, জনপ্রতিনিধি ও জেলেদের নাম এসেছে। এক অনুসন্ধান জানা জানা যায়, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে দেশটির সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে চলমান গৃহযুদ্ধে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এমনকি পশ্চিম আরাকানের (রাখাইন রাজ্য) বন্দর শহর মংডুর সঙ্গে জেলা ও বিভাগীয় শহর আকিয়াব এবং রাজধানী ইয়াংগুনের যোগাযোগ রক্ষাকারী সড়কও বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এসব কারণে পণ্যসামগ্রী পরিবহনে সর্বত্র গুরুতর সংকট দেখা দিয়েছে। পশ্চিম আরাকানসহ আকিয়াব, ভুচিদং, রাশিদং ও মংডু এলাকায় নিত্যপণ্যের দাম এখন আকাশছোঁয়া। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি (অটোমেটেড প্রাইসিং ফর্মুলা) কার্যকর করার শর্ত দিয়েছিল। আইএমএফর শর্ত পূরণে ডিজেল, পেট্রল, অকটেনসহ জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে নিয়মিত সমন্বয় করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। শুরুতে এটি তিন মাস পরপর নির্ধারণের পরিকল্পনা ছিল। তবে এখন প্রতি মাসে দাম নির্ধারণের চিন্তা চলছে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে মূল্য সমন্বয়ের প্রক্রিয়াটির এখন চূড়ান্ত পর্যায়ের কাজ করছে বিপিসি। কক্সবাজারের স্থানীয়রা বলছেন, জ্বালানি তেল পাঁচারের এ নেপথ্যে রয়েছে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ ভিত্তিক মাদক ব্যবসায়ীরা। যারা ইয়াবা ও আইসের পাশাপাশি বর্তমানে তেল পাঁচার করছে। মিয়ানমার থেকে আসা এ চালান কক্সবাজার-চট্টগ্রাম হয়ে চলে যাচ্ছে পাশ্ববর্তী দেশও। তারা অভিযোগ করে বলেন, বাহারছড়ায় পুলিশের একটি তদন্তকেন্দ্র বা ফাঁড়ি থাকলেও কেন্দ্রটির পুলিশ পাঁচারের কোনো চালান আটক করতে পারেনি। মংডুুর এক ব্যবসায়ী জানান, বাংলাদেশের এক টাকার পরিমাণ এখন মিয়ানমারের ২৭.৫০ কিয়েত। মংডু শহরে ৫০ কেজির এক বস্তা পুরনো চালের দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় এখন আট হাজার ৯২৮ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজির দাম ১৭৮ টাকা। প্রতি লিটার ভোজ্য তেলের দাম এক হাজার ৪৫০ টাকা, প্রতি লিটার অকটেনের দাম ৬০০ টাকা, প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ৪০০ টাকা। এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, মেরিন ড্রাইভে বসে এক লিটার অকটেন মিয়ানমারগামী নৌযানে তুলে দিতে পারলেই ১৬৫ টাকা নগদ লাভ আসে। এসব কারণে জ্বালানি ও ভোজ্য তেল পাঁচারে জড়িয়ে পড়ছে এলাকার অনেকে। কক্সবাজার র্যাব-১৫ থেকে জানা গেছে, বেশ কিছুদিন ধরে এভাবে কক্সবাজার থেকে সাগরপথে মিয়ানমারে জ্বালানি ও ভোজ্য তেল পাঁচার হচ্ছে। অধিক লাভের সুযোগে উপকূলীয় এলাকার অনেকে এই অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েছেন। টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো, ওসমান গণি সংবাদ মাধ্যমে বলেন, অনেক দিন আগে থেকেই মিয়ানমারে পাঁচার হচ্ছে জ্বালানি ও ভোজ্য তেল। গত ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে আমাদের পুলিশ দুই দফার অভিযানে মিয়ানমারে পাঁচারকালে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি ও ভোজ্য তেলের চালান উদ্ধার করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় সমন্বয় পদ্ধতি চালু করার আগেই ইনভয়েস ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ন করে প্রাইসিং ফর্মুলা প্রণয়ন করতে হবে। তাহলে তেল পাঁচার রোধ করা সম্ভব হবে। তা না হলে কোনোভাবেই এই তেল পাঁচার বন্ধ করা সম্ভব হবে না বলেও তারা জানান।