কালের পরিক্রমায় আধুনিকতা ও কালের বিবর্তনে জনপদ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে খেজুরের গাছ ও রস। একসময় গ্রামীন জনপদের রাস্তার মেঠো পথের দুই পাশেই চোখ বুলালেই দেখা যেত খেজুর গাছের সারি। বর্তমানে এমন দৃশ্য সহজেই দেখা মেলেনা তা প্রায় বিলুপ্তির পথে। গ্রামাঞ্চলে খেজুরের গুড় ও রস ছিল সর্বজন সমাদৃত। কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে দিন দিন খেজুরের গাছ কমতে থাকায় গাছিরাও বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা। শীতের মৌসুম আসলে খেজুর গাছে গাছে ঝুলানো দেখা যতো মাটির তৈরি রসের হাড়ি। কনকনে শীতে হারিকেন জ্বালিয়ে খেজুর রস চোরের ভয়ে গভীর রাত পর্যন্ত রসের হাড়ি পাহারা দিত। শীতের বিকেলে মাটির তৈরি রসের হাড়ি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করত গাছিরা। ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড়ের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও ঝিনাইদহ জেলায় দিন দিন কমে আসছে খেজুর গাছের সংখ্যা। যে কারণে এখন ব্যাপক হারে কমছে গাছিদের সংখ্যা। যে গাছগুলো আছে তাতেও তেমন রস মিলছে না। চাহিদার তুলনায় রসের জোগান অনেক কম থাকায় ভেজাল গুড়ে বাজার সয়লাব হচ্ছে। ফলে আসল খেজুর গুড়ের স্বাদ হতে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারন মানুষ। এক শ্রেনীর অসত মানুষ খেজুরের গুড়ের সাথে বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশিয়ে গুড়ের রং সুন্দর করে বাজারে বিক্রি করছে। অনেকে গুড়ের সাথে চিনি মিশিয়ে বিক্রি করছে অধিক মুল্যে। যে কারণে সাধারন ক্রেতাদের চিনার কোন উপায় থাকে না এ গুড়ে ভেজাল আছে কিনা। বাজারে খেজুর গুড়, পাটালির চাহিদা রয়েছে ব্যাপক হারে কিন্তু সে পরিমান পাওয়া যায় না ও যা পাওয়া যাচ্ছে তার বেশির ভাগই ভেজাল। ঝিনাইদহ জেলাটি ৬ উপজেলা ও ৬ পৌরসভা রস আহরণ যোগ্য খেজুর গাছ রয়েছে, কিন্তু অতিতের ন্যায় খেজুর গাছ নেই, এ কারণে রসের পরিমান ও কম হয়ে থাকে। এখন থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে গ্রাম এলাকায়, ফাকা মাঠ ও রাস্তার পাশে বসত বাড়িতে এবং রাস্তার দুই ধারে সারি সারি খেজুর গাছ ছিল। এখনো যে গাছ রয়েছে তা থেকে শীতকালীন কিছু গাছের রস সংগ্রহের কাজ চালছে। সারা বছর অবহেলায় পড়ে থাকা অগোছালো খেজুর গাছ গুলোকে প্রস্তুত করে নলি ও ভাড় ঝুলিয়ে দিলেও চাহিদা মতো রস মিলছে না। আবার ব্যাপক হারে গাছি সংকটে অনেক খেজুর গাছ পূর্বের অগোছালো অবস্থায় পড়েও থাকছে। শীতের সময় রস সংগ্রহের পরে খেজুর গাছ গুলোতে আর পরিচর্যা করা হয় না বলে গাছে শীতের সময় রস হয় না। বিশেষ করে প্রতিটি এলাকায় কৃষকরা তাদের অভাব অনটনের কারণে রসের খেজুর গাছ গুলি কেটে ইট ভাটায় বিক্রি করে দিয়েছে অনেকেই। ক্রমান্বয়ে রয় সংগ্রহের কাছ সংকট দেখা দিচ্ছে ও গুড়ের চাহিদা বেশি বলেই এখন গুড়ের দাম অনেক বেশি। খেজুরের রস দিয়ে তৈরি হয় সুস্বাদু গুড় এবং পাটালিসহ নানা ধরনের পায়েশ।,গ্রাম অঞ্চলে শীতের পুরো মৌসুমে চলে রস,গুড়,পিঠা,পুলি ও পায়েস খাওয়ার উৎসব। শহরে বসবাসকারী শীত মৌসুমে সন্তানদের নিয়ে গ্রামেবেড়াতে যান এ উৎসবের শামিল হতে। কিন্তু সে তুলনায় ঝিনাইদহ জেলায় রসের জোগান তুলনামূলক অনেক কম থাকায় বাজারে বিক্রি হচ্ছে ভেজাল গুড়। ফলে আসল খেজুর গুড়ের স্বাদ হতে বঞ্চিত হচ্ছে বর্তমান বিপুল জনগোষ্ঠী এবং হুমকির মুখে পড়ছে মানব স্বাস্থ্য। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনসহ মাটি লবণাক্ততা ও নজরদারি না থাকায় গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী পরিবেশ বান্ধব খেজুর গাছ এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। রামনগর গ্রামের মহিদুল ইসলাম, এলাঙ্গি গ্রামের লিটন বিশ্বাস জানান,আগে শীত কালে যে পরিমান রস হত এখন তাদের অনেক গাছ বিক্রি করে দিয়েছে, ফলে রস এখন আগেরমত পাওয়া যায় না। যে গাছ রয়েছে সেগুলো অন্যের কাছে রসের অর্ধেক ভাগা চুক্তিতে ও গুড়ের ভাগ চুক্তিতে কাটছেন। শীত মৌসুমে রস ও গুড় থেকে আগে যে পরিমান আয় হত এখন সে পরিমান গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী রস থেকে গুড় উৎপাদন করে বিক্রি করা যাচ্ছে না। তবে এসব কারণে এ পেশায় তেমন আয় করা সম্ভব হচ্ছে না ও গাছ কেটে আগেরমত রস গুড়ে লাভ হয় না। একসময় গ্রাম এলাকায় অধিকাংশ মানুষের মাছ ও বাড়িতে খেজুর গাছ ছিল, তারা নিয়মিত রস গুড় পেত। কিন্তু বর্তমানে খেজুর গাছ কমে যাওয়ায় রসও কমে গেছে তাই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ আগের মতো রস খেতে পারে না। তাছাড়া ইট ভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের কারণেও খেজুর গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তিনি।আগেকার দিনে বিভিন্ন এলাকায় শিশু কিশোরেরা খেজুরের রস দিয়ে পায়েস উৎসব করলেও রস আহরণ যোগ্য খেজুর গাছ কমে যাওয়ায় বর্তমানে তা আর দেখা যায় না। গ্রাম এলাকার মানুষ দল বেধে সন্ধার পরে সন্ধা রস খেতে পাঠে যেত, অনেকে সন্ধার রস নিয়ে পায়েস রান্না করে খেত। খেজুর গুড়ের চাহিদা থাকায় উৎপাদিত গুড়ের ভালো দাম পাঁচ্ছেন চাষিরা। তবে কমেছে উৎপাদন। মূলত গাছ ও গাছির সংখ্যা কমছে বলে উৎপাদনের পরিমাণ অনেক কম বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। নলেন, পাটালি ও ঝোলা গুড়ের চাহিদা শীতের সময়, এখানকার গুড়ের চাহিদা থাকায় প্রতিবছর কার্তিক মাসের শুরুতেই খেজুর গাছ ছেঁটে রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরি শুরু করেন এলাকার চাষিরা। প্রতিদিন প্রচন্ড শীত সকালে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ ও জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হয়। আর উৎপাদিত গুড়ের দামও ভালো পাঁচ্ছেন চাষিরা।তবে গাছিদের দাবি, গাছ ও গাছির সংখ্যা কমার পাশাপাশি নানা কারণে গুড় উৎপাদন কমে গেছে।স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, একসময় প্রচুর খেজুর গাছ থাকলেও এখন প্রতিনিয়ত গাছের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া গাছিও কমে গেছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে গুড় উৎপাদন। এক সময়ে গাছিরা এক ভাড় কাঁচারস বিক্রি করত ৩০ থেকে ৪০ টাকা করে আর এখন সে রস প্রতি ভাড় বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা করে তা পর্যাপ্ত হারে পাওয়া যায় না। এ ছাড়া গুড়ের দামও ছিল ৭০ থেকে ৮০ টাকা করে কেজি, হাগিদার তুলনায় গুড় ও বেশি ছিল। আর এখন এক কেজি খাঁটি গুড়ের দাম ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে এবং নির্ভেজাল গুড় পাওয়া কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বেশির ভাগ ভেজাল অর্থাৎ চিনি ও কেমিক্যাল মেশানো খেজুরের গুড়ে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। এসব ভেজাল গুড় ক্রেতাদের বুঝা খুব কষ্টকর ব্যাপার। বর্তমানে যে সব গ্রামাঞ্চলে যে কযেকটা খেজুর গাছ দেখা গেছে তাতে মাটির তৈরি হাড়ির পরিবর্তে প্লাস্টিকের পানির বোতল ব্যবহার করছে। শীত মৌসুম আসলে যে সব গ্রামে খেজুর গাছ ছিল প্রায় বাড়িতে নতুন ধানের চাউল দিয়ে খেজুরের রসের পায়েশ রান্না দুধ চিতই পিঠা বানানোর ধুম পড়তো। আর গ্রামের মানুষ স্বজনদের নিয়ে অতিআনন্দে পায়েশ ও দুধ চিতই পরিবেশন করতো। এখন তা ফুরিয়ে গেছে। সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিলে খেজুর গাছ দেশ থেকে বিলীন হবে না। গ্রামীন এই ঐতিহ্য প্রকৃতিক সম্পদ বিলীনের হাত থেকে বাঁচতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এগিয়ে আসতে হবে। শীত মৌসুমে শীত যতো বাড়তে থাকে খেঁজুর রসের মিষ্টতাও ততো বাড়ে। শীতের সাথে রয়েছে খেঁজুর রসের এক অপূর্ব যোগাযোগ। শখের বসত প্রাকতিক ভাবে জন্মানো খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহকারী গাছিদের মতে, আগের মতো খেজুর গাছ না থাকায় এখন আর সেই রমরমা অবস্থা নেই। ফলে শীতকাল আসলেই অযতেœ অবহেলায় পড়ে থাকা গ্রামীন জনপদের খেজুর গাছের কদর বেড়ে যায়। বর্তমানে চাহিদার তুলনায় খুবই কম। খেজুর গাছ রক্ষায় বন বিভাগ ও প্রশাসনের কার্যকরী কোন পদক্ষেপ না থাকায় ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে খেজুর গাছ আর শীতের মৌসুমে খেজুর গাছের রস শুধু গল্পে পরিনত হতে চলেছে।