পাহাড়কে বলা হয় পৃথিবীর পেরেক। পেরেক মেরে যেমন কিছু আটকে রাকা যায়, তেমনি পাহাড়ও পৃথিবীর উপরিস্থলের প্লেটগুলোকে আঁকড়ে ধরে রাখে। নির্বিচারে পাহাড় কাঁটার ফলে পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য প্রতিনিয়ত হুমকির মধ্যে পড়ছে। পরিবেশগত অবক্ষয়ের পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি বর্ষায় মূল্যবান প্রাণ কেড়ে নেয় ধ্বংসাত্মক ভূমিধ্বস এবং কাদা প্রবাহের পরে পাহাড় কাটা মারাত্মক রূপ নেয়। নদনদী, গাছপালার মতোই পাহাড় পরিবেশ-প্রতিবেশের এক বিশেষ অনুষঙ্গ, যার বিনাশ পৃথিবীকে নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ঠেলে দেয়। বর্ষা মৌসুম এলেই দেশে পাহাড় কাঁটার ধুম পড়ে যায়। বাংলাদেশের পাহাড় অঞ্চল চট্টগ্রাম সিলেটের ও মৌলভীবাজারে পাহাড় কাঁটার মহোৎসবের খবর প্রায় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। তাতে যেমন এলাকার নান্দনিকতা নষ্ট হচ্ছে তেমনি প্রকৃতির ভারসাম্য পড়েছে হুমকির মুখে। এমনকি পাহাড়ধসে মানুষের মৃত্যু এক চরম বেদনাদায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে পাহাড় কাটা চলছে। পাহাড় কাঁটার ঘটনায় পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় থানা পুলিশ মামলা করলেও তা বন্ধ হচ্ছে না। কর্তৃপক্ষের দূরদৃষ্টির অভাব ও পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের প্রতি সংবেদনশীলতার ঘাটতির ফলে পাহাড় কাটা বন্ধ হচ্ছে না। অতীতের প্রাণহানির মত বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে পাহাড় কাটা অব্যাহত রয়েছে। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, বিদ্যালয় ভবন, ইটভাটা নির্মাণ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে এ জাতীয় কার্যক্রম চলছে। ২০০০ সালে সংশোধিত বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ করেছে। আইনে বলা আছে, অনুমোদন ছাড়া পাহাড় কাঁটার জরিমানা প্রথম অপরাধে দুই বছরের কারাদন্ড-, দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড-। পরবর্তী অপরাধে জরিমানা দশ বছরের কারাদন্ড-, দশ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দন্ডিত হতে পারে। মৌলভীবাজার এবং শ্রীমঙ্গলে গৃহহীনদের আবাসনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে যে বাড়িগুলো নির্মাণ করা হয়েছে, তাতে পাহাড় এবং প্রকৃতি প্রচুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাহাড় কেটে ও পাহাড়ের গাছপালা কেটে আশ্রয়হীনদের জন্য নির্মিত বাড়িঘর এখন বসবাসকারীদের জন্য অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। আশ্রয়হীনদের বাড়ি ঘরে যেকোনো মুহূর্তে পাহাড় ধসে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কাও রয়েছে। নির্বিচারে পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন এবং বন-জঙ্গল ও গাছপালা উজাড় করার কারণেই সিলেট মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ঘনঘন পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা যারা পাহাড় কাঁটার সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ। প্রভাবশালী লোকের নির্দেশে রিসোর্ট হোটেল-মোটেল নির্মাণের নামে পাহাড় কাটা বন্ধের ব্যবস্থা করতে হবে। পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে বেআইনিভাবে পাহাড় কাটা রোধে এবং পাহাড়ে বসবাসকারীদের সুরক্ষায় সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।