ব্যাংক এশিয়ার এজেণ্ট ব্যাংক থেকে প্রবাসি’র প্রায় ৬৩লাখ টাকা গায়েব করে দিয়েছেন ব্যাংক এশিয়ার ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের আউটলেটে দায়িত্বে থাকা ঝিনাইদহ জেলা পরিষদের সদস্য ও কোটচাঁদপুর এলাঙ্গী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাজিবুল কবির রাজিব। বিষয়টি নিয়ে ব্যাংক তদন্তে নেমেছে।
ভূক্তভোগী কোটচাঁদপুর উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামের আবদুল মাজেদণ্ডএর ছেলে কুয়েত প্রবাসী রোকনুজ্জামান রোকন জানান- তিনি গত ২০বছর ধরে প্রবাসে (কুয়েত) থাকেন। ২০১৯ সালে তিনি দেশে এসে কোটচাঁদপুর ব্যাংক এশিয়া এজেণ্ট আউটলেট-এ আঙ্গুলের ছাপের মাধ্যমে একটি সঞ্চায়ী হিসাব খুলে তিনি কুয়েত চলে যান। যার হিসাব নং-১০৮৩৪৪৪০০৬১০৬। এ সময় এজেণ্ট আউটলেটের দায়িত্বে ছিলেন কোটচাঁদপুর উপজেলার মৃত কাওসার মণ্ডলের ছেলে মনিরুল ইসলাম। পরবর্তীতে কুয়েত প্রবাসী রোকনুজ্জামান রোকন দেশে এসে ২০২০ সালের মার্চ মাসের ২ তারিখে ব্যাংক এশিয়ার এজেণ্ট আউটলেটে ৪০লাখ ও ১০লাখ টাকার আলাদা দুইটি মাসিক মুনাফা সঞ্চায়ী হিসাব খোলেন। যার দুটি হিসাব নং- ১০৮২৭৪৪০০০০০৮ ও ১০৮২৭৪৪০০০০০৯। এ দুটি হিসাবের মেয়াদ পূর্তির তারিখ ছিল ১৫/০২/২০২৩-ইং। এ সময় বলা হয়েছিল প্রতি মাসে ৩৫হাজার টাকা লভ্যাংশ দেবে ব্যাংক। সে অনুযায়ী অ্যাকাউন্ট গুলিতে ৩বছরে লভ্যাংশ ও মূলধনসহ প্রায় ৬৩লাখ টাকা জমা হওয়ার কথা। অথচ প্রবাসী রোকন ২০২৩ সালের জুলাই মাসে তিনি দেশে ফিরে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে গেলে তিনি জানতে পারেন প্রবাসে থাকা অবস্থায় তার সমুদয় টাকা অ্যাকাউন্ট ৩টি থেকে গায়েব হয়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে ভূক্তভোগী রোকনুজ্জামান রোকন ইতোমধ্যে এজেণ্ট ব্যাংকিং ডিভিশন, ব্যাংক এশিয়া লিমিটেড ঢাকা, ব্যাংক এশিয়া ঝিনাইদহ শাখা ও বাংলাদেশ ব্যাংক ঢাকাতে অভিযোগ শাখায় লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন। রোকন এ প্রতিবেদককে বলেন, দীর্ঘ দিন প্রবাসে থেকে খুব কষ্টে অর্জিত টাকা গুলি তিল তিল করে জমিয়ে ছিলাম। বিশ্বাস করে টাকা গুলি ব্যাংকে আমানত রেখেছিলাম। এখন দেখছি ব্যাংকেও আমানতের টাকা খেয়ানত করা হয়। ব্যাংক গ্রাহকরা বিশ্বাস করবে কারে ? এখন চরম বিপদে পড়েছি। তিনি বলেন, আউটলেটের সাথে ব্যাংক এশিয়ার কিছু কর্মকর্তারা জড়িত। তা না হলে আমি প্রবাসে থাকা অবস্থায় আমার মুনাফা সঞ্চয়ী হিসাব থেকে টাকা উঠলো কি করে ?
এ অভিযোগ পাওয়ার পর এ প্রতিবেদক বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে নামেন। ব্যাংক এশিয়া ও আউটলেটের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে তিনি জানতে পারেন, ২০২১ সালে ব্যাংক এশিয়ার আউটলেটের দায়িত্বে থাকা মনিরুল ইসলাম ব্যাংকের দায়িত্বভার (ব্যাংকের অনুমতিক্রমে) তার আপন ভাই ঝিনাইদহ জেলা পরিষদ সদস্য রাজিবুল কবির রাজিবের কাছে দেন। এরপর মনিরুল ইসলাম ডাচ বাংলা ব্যাংক ঝিনাইদহ শাখায় যোগদান করেন। পরবর্তীতে ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে আউটলেটের দায়িত্বে থাকা রাজিব প্রবাসে থাকা রোকনুজ্জামান রোকনের মাসিক মুনাফা সঞ্চায়ী হিসাব দু’টি ভেঙ্গে ফেলে সমুদয় টাকা প্রবাসী রোকনের আরেকটি সঞ্চায়ী হিসাব নং-১০৮৩৪৪৪০০৬১০৬-এ নিয়ে আসেন। এই হিসাব থেকে চতুর রাজিব নিজের দুটি হিসাব নম্বরে প্রায় ৩০লাখ টাকা ট্রান্সফার করেন। বাকী টাকা আরো ২ থেকে ৩টি গ্রাহকের হিসাব নম্বরে নিয়ে আসেন। পরে ওই গ্রাহকদের হিসাব থেকেও টাকা গুলি তুলে নেন রাজিব। এখানে আশ্চার্য্যরে বিষয় হচ্ছে গ্রাহকের হিসাব থেকে মোট অংকের টাকা তোলা হলেও তারা জানতে পারেননি। নাম প্রকাশ না করার স্বর্তে একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেন, হিসাব খোলার শুরুতেই টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে আঙ্গুলের ছাপ জ্বালিয়াতি করা হয়েছে। যে কারণে পূর্বে আউটলেটের দায়িত্বে থাকা মনিরুল ইসলাম (বর্তমান ডাচ বাংলা ব্যাংক ঝিনাইদহ শাখায় কর্মরত) ও তার ভাই ঝিনাইদহ জেলা পরিষদ সদস্য রাজিবুল কবির রাজিবকেই এই জালিয়াতির দায় নিতে হবে। রাজিবের ভাই মনিরুল ইসলাম কোন ভাবেই দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। কেননা মনিরুল ইসলাম আউটলেটে দ্বায়িত্বে থাকা অবস্থায় আঙ্গুলের ছাপ জালিয়াতি করা হয়েছে। পরে তার ভাই রাজিবুল কবির রাজিব আউটলেটের দায়িত্বে এসে গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- টাকা উদ্ধারে স্থানীয় চেয়ারম্যানসহ কয়েক জন গণ্যমান্য ব্যক্তি রাজিবকে নিয়ে বসেন। সে সময় রাজিব টাকা উঠিয়ে নেয়ার কথা স্বীকার করে এবং বলে টাকা তার কাছ থেকে নিতে হলে সময় দিতে হবে। (রাজিবের এ স্বীকারোক্তির অডিও এ প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে)। এরপর কয়েক দফা সময় নিয়েও টাকা ওই একাউণ্টে জমা না দেয়ায়। বিষয়টি নিয়ে ব্যাংক এশিয়া ঝিনাইদহ শাখার ম্যানেজার সাইফুর রহমান রাজিবকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। সেখানেও সে অপরাধের কথা স্বীকার করলেও আজ পর্যন্ত প্রতারক রাজিবের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার হয়নি। অভিযুক্ত রাজিবের বিষয়টি নিয়ে ব্যাংক এশিয়ার ঝিনাইদহ শাখার ম্যানেজার সাইফুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন- গ্রাহক প্রবাসী রোকনুজ্জামান রোকনের আবেদন আমরা পেয়েছি। আমাদের হেড অফিসে কর্তারা বিষয়টি জেনেছেন। জালিয়াতির বিষয়টি আমাদের কাছে পরিস্কার। টাকা উদ্ধারের পদক্ষেপ নিচ্ছে হেড অফিস।
উপজেলার এলাঙ্গী ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান খান বলেন- টাকা জালিয়াতির বিষয়টি রাজিব স্বীকার করে টাকা ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলেছিলো। অথচ এখন সে বলছে টাকা আমি দিতে পারবো না। পারলে ব্যাংক আমার বিরুদ্ধে মামলা করে টাকা আদায় করে নিক। এখন আমি আর কি করতে পারি ?
এদিকে এ ঘটনা এলাকায় জানাজানি হওয়ায় রাজিব আত্মসাৎকৃত টাকা নিয়ে দোবাই পাড়ি জমানোর পায়তারা চালাচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে। যে কোন সময় সে দেশ ত্যাগ করতে পারে। এদিকে বিষয়টি নিয়ে সকল ব্যাংকের আউটলেটের সাধারণ গ্রাহকরা ভীতু সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। সে কারণে গ্রাহকরা আউটলেটের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে টাকা আত্মসাৎকারী রাজিব ও প্রতারণার সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তারসহ দ্রুত ভুক্তভোগীর সমুদয় টাকা ফেরতের দাবী জানিয়েছে।