পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কে যানবাহনের চাঁপ যেমন বেড়েছে, তেমনিভাবে কমেছে ঢাকা-বরিশাল নৌ-রুটের যাত্রী। ফলে লঞ্চগুলো প্রায় বন্ধের উপক্রম। রোটেশন করে কোনোভাবে টিকে আছে লঞ্চ মালিকরা। তারপরেও বন্ধ হয়ে গেছে অনেক বিলাসবহুল লঞ্চ। অপরদিকে মহাসড়কে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মোটরসাইকেল নিয়ে পদ্মা সেতু পার হওয়া ঢাকামুখী মানুষের স্রােত। আর এই সুযোগে ঢাকা-বরিশাল ও কুয়াকাটা মহাসড়ক পরিণত হয়েছে মরণফাঁদে। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ঝড়ছে প্রাণ। মৃত্যুঝুঁকি এড়াতে তাই আবারও লঞ্চ নির্ভর হতে চায় সাধারণ মানুষ। তবে এবার তাদের বেশিরভাগই চাচ্ছেন দিনে যেয়ে আবার সন্ধ্যায় ফিরে আসতে। এজন্য দিনে বরিশাল-ঢাকা নৌপথে লঞ্চ চলাচল শুরুর দাবি জানিয়েছেন যাত্রীদের বড় একটি অংশ। এদের মধ্যে রয়েছেন বাইক রাইডাররাও। বেশিরভাগ যাত্রীরা চাচ্ছেন বরিশাল থেকে সকাল দশটার মধ্যে ঢাকায় পৌঁছাতে এবং ঢাকা থেকে রাত দশটার মধ্যে বরিশালে ফিরতে। আর এজন্য তিন থেকে চারঘন্টায় বরিশাল-ঢাকা থেকে পুনরায় বরিশাল হতে হবে লঞ্চ সার্ভিস। লঞ্চ চালকদের দাবি, এটা সম্ভব। কেননা রাতে চলাচলকারী বেশিরভাগ লঞ্চ রাত নয়টায় ঢাকা ত্যাগ করে ভোর চারটার মধ্যেই বরিশালে পৌঁছে যায়। তাই দিনের বেলা গতি কোনো সমস্যা নয়, নদীতে নিয়মিত ড্রেজিং হলে এটা অবশ্যই সম্ভব বলে জানিয়েছেন এমভি আওলাদ ও শুভরাজ লঞ্চের মালিক যুবরাজ। সূত্রমতে, ২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধণ হওয়ার পর প্রথমদিকে সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ ছিলো। এরপর তা সবার জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এতে সকালে ঢাকায় পৌঁছে প্রয়োজনীয় কাজকর্ম শেষ করে সন্ধ্যায় ফিরে আসার প্রবণতা বেড়েছে। এসময়ে যাত্রী চাঁপ বেশি বলে জানিয়েছেন অনেক বাসচালক। বৃহস্পতিবার সকালে বরিশালের নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালে দুরপাল্লার কাউন্টারগুলোতে দেখা গেছে ঢাকামুখী যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড়। তাদের বেশিরভাগই ব্যবসায়ী এবং ইসলামপুরে ও চকবাজার যাচ্ছেন পণ্য ক্রয় করতে। পরিবহন কাউন্টারের ম্যানেজাররা জানান, বেশিরভাগ যাত্রী এখন সকালে যেয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসার চেষ্টা করেন। তাই সকাল, সন্ধ্যা যাত্রীদের চাঁপ বেশী। বরিশাল বিআরটিসির ব্যবস্থাপক জমশেদ আলী জানান, সকালে ঢাকামুখী যাত্রীদের প্রচন্ড চাঁপ থাকে বরিশাল কাউন্টারে। এদের বেশিরভাগই সন্ধ্যার ফিরতি টিকিট কেটে রাখেন। ঢাকামুখী একাধিক মোটরসাইকেল চালক বলেন, জরুরী প্রয়োজনে ঢাকায় যাচ্ছি। বিকেলের মধ্যে ফিরে আসতে চাই। তবে ঢাকার পোস্তগোলা থেকে যানজটে আটকে যেতে হয়। শহরে ঢুকতে প্রায় ঘন্টা দুই পাড় হয়ে যায়। হানিফ ফ্লাইওভারেই কেটে যায় কয়েক ঘন্টা। এ সময় বেশ কয়েকজন চালক সকাল ছয়টা থেকে বরিশাল-ঢাকা নৌপথে লঞ্চ চলাচলের দাবি করেন। তারা বলেন, মোটরসাইকেল বহনের পৃথক সুবিধা দিয়ে ও ভাড়া সহনীয় করে দিনে লঞ্চ চলাচল হলে যাত্রীদের ভিড় হবে লঞ্চে। এদিকে পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে দূর্ঘটনার হারও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে পদ্মা সেতু চালুর পর গত একবছরে ৬৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ৯৭ জন। সর্বশেষ গত ৫ জানুয়ারি ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের গৌরনদী উপজেলার দক্ষিণ বিজয়পুর এলাকায় সাকুরা পরিবহনের একটি বাসের চাঁপায় মোটরসাইকেল চালকসহ দুইজন নিহত হয়েছেন। সড়কের এই দুর্ঘটনা আরো বাড়ার আতঙ্কে ভাঙা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা মহাসড়কে দ্রুত ছয়লেনে উন্নতীর জন্য দাবি করেছেন বাস মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দসহ সর্বস্তরের যাত্রীরা। সূত্রমতে, ভাঙা থেকে গৌরনদী পর্যন্ত মহাসড়কের দুইপাশের বড় বড় গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে সড়ক বর্ধিত করার নামে। কিন্তু জমি অধিগ্রহণ এখনো শেষ হয়নি। তাই দিনের বেলা লঞ্চ চলাচলের উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন সুশীল সমাজ ও সাধারণ যাত্রীরা। নগর চিন্তাবিদ কাজী মিজানুর রহমান বলেন, লঞ্চ মালিকরা পরীক্ষামূলকভাবে একসপ্তাহ ভোর ছয়টা থেকে যাত্রী ও মোটরসাইকেল পরিবহন করে দেখলে ক্ষতি কি? এতে তাদেরই লাভ। তবে ভাড়াটা মোটরসাইকেলসহ পাঁচশ’ টাকার মধ্যে হলেই ভালো হবে। তার এ বক্তব্যে সহমত যাত্রীদের অনেকে। একাধিক যাত্রীরা বলেন, এ ক্ষেত্রে লঞ্চ মালিকরা সাধারণ যাত্রীদের জন্য নরমাল চেয়ার সিস্টেম করতে পারেন। ভিআইপি বা ভিভিআইপি পৃথক হতে পারে। তবে অবশ্যই মোটরসাইকেল ওঠানামার জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং ঘাট ইজারাদারদের ঝামেলা থাকতে পারবে না। লঞ্চ মালিক সমিতির সহ-সভাপতি ও সুন্দরবন নেভিগেশন কোম্পানির চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে যাত্রী কমবে এটি আমরা ধরে নিয়েছিলাম। তবে লোকসানে পরতে হয়নি। কিন্তু দুই দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় আমরা দিশেহারা। একদিকে যাত্রী সংকট অন্যদিকে তেলের মূল্য বৃদ্ধি হওয়ায় ঝালকাঠি রুটে সুন্দরবন-১২ লঞ্চটি বন্ধ রাখা হয়েছে। বর্তমানে ওই রুটটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় দিনের আলোতে লঞ্চ চলাচলের ঝুঁকি কেউ নিতে চায়না। তবে আমি বিষয়টি নিয়ে সমিতির বৈঠকে আলোচনা করবো। বাংলাদেশ লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা যে হারে বাড়ছে তাতে যাত্রীরা পুনরায় লঞ্চ নির্ভর হবে বলে আমি আশাবাদী। তবে এজন্য হয়তো আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে। মাহবুব উদ্দিন বলেন, দিনের বেলা লঞ্চ চলাচলে আমাদের আপত্তি নেই। তবে এজন্য বিআইডব্লিউটিএ’র অনুমোদন প্রয়োজন। বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা জানান, সকাল ছয়টা বা সাতটা থেকে লঞ্চ চলাচল ও মোটরসাইকেল বহন করায় বিআইডব্লিউটিএ’র পক্ষ থেকে কোন নিষেধাজ্ঞা বা বিধিনিষেধ নেই। লঞ্চ মালিকরা যদি মনে করেন তারা দিনে চালাবেন তাহলে শুধু আমাদের কাছে আবেদন করলেই হবে। তবে মোটরসাইকেল বহন ভাড়াটা সহনীয় হওয়াই উত্তম বলেও তিনি উল্লেখ করেন।