সিজোফ্রেনিয়া একটা জটিল মানসিক রোগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানসিক রোগের মধ্যে এটাই সবচেয়ে জটিল এবং এটার চিকিৎসাও জটিল। এই রোগ পুরুষ নারী উভয়ের সমানভাবে হয়। তবে পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশে প্রতি একশ জনের মধ্যে একজন এই রোগে আক্রান্ত হয়। সুইডেনের মনোচিকিৎসক ইউজেন ব্লিউলার ১৯১১ সালে সিজোফেন্সনিয়া শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। শব্দটি এসেছে মূলত গ্রিক ভাষা থেকে। সিজোফ্রেনিয়ার প্রথম অংশটিকে বলা হয় ‘সাইজো’বা ‘সিজো’, যার অর্থ ভাঙা বা টুকরো। দ্বিতীয় অংশ হলো ‘ফেন্সনিয়া’অর্থাৎ মন। কাজেই সিজোফেন্সনিয়ার পুরো শাব্দিক অর্থ দাঁড়ায় ভাঙা মন বা যে মন টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। মনোচিকিৎসক ব্লিউলারের থিউরি অনুসারে যখন আমাদের মস্থিস্কের কর্ম পদ্ধতি বোধশক্তি এবং বাস্তবতা কে চিন্তা শক্তিতে নিয়ে এককরে মিল রাখতে পারেনা তখন ই সিজোফেন্সনিয়ার অসুখটির শুরু হয় যাকে আমরা স্মৃতিভ্রষ্ট বলেও জানি। অর্থাৎ এই রোগ হলে মানুষ কোন কিছু মনে রাখতে পারে না। যে কোন বয়সে হতে পারে তবে ৯৬% যাদের বয়স ১৫ -৩০-এর মধ্যেই বেশী হয়। বয়স ৪০-এর ওপরে গেলেও সিজোফ্রেনিয়া হতে পারে ৬ শতাংশের বেলায়। শিশুদের হয়ে থাকে তবে বেশি হয়ে থাকে মায়ের গর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় - তখন মা এবং সন্তান দুজন-ই ভুগতে পারে। বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইক্রিয়াট্রিস্ট বলছে রোগটি নিয়ে মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণাও রয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন ২০ বছর বয়সের শুরুর দিকে এই রোগে আক্রান্তের হার বেশি। তবে ৪৫-এর পর এটা কমে যায়। ৫০ বছরের পর আর হয় না। ৫৫ বছরের পর নতুন করে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা খুব কম।
সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ:
১. আচরণের পরিবর্তন: এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের কথা বলা বা লেখায় অযৌক্তিক ধরন বা আচরণ প্রকাশ পায়। রোগী এমন কিছু শুনতে পায় বা দেখতে পায় যেটা বাস্তবে থাকে না।
২. উদাসীনতা: গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে উদাসীনতা দেখান। কোন কিছুতে মনোযোগ দিতে পারে না। কিংবা গুরুত্বের বিষয়ও বুঝতে পারে না। এমনকী নিজের যত্ন নেয়ার প্রতিও উদাসীন হয়ে পড়ে।
৩. ক্লান্তি: সব সময় ক্লান্ত বোধ করা এই মানসিক রোগের একটি সাধারণ লক্ষণ। ঘুমের ব্যাঘাত, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা বা মানসিক চাপের প্রতি শরীরের প্রতিক্রিয়া সহ বেশ কয়েকটি কারণের কারণে ক্লান্তি হতে পারে।
৪. নানা রকম ব্যথা: পেশী ব্যথা এবং মাথা ব্যথা মানসিক অসুস্থতার আরেকটি সাধারণ লক্ষণ। মাথাব্যথা ও সাধারণ উপসর্গ, এবং স্ট্রেস, টেনশন এবং উদ্বেগ সহ বিভিন্ন কারণের কারণে হতে পারে।
৫.ঘুমের সমস্যা: ঘুমের সমস্যা, যেমন অনিদ্রা, মানসিক অসুস্থতার একটি সাধারণ উপসর্গ। মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা বিষণ্ণতাসহ বেশ কয়েকটি কারণের কারণে ঘুমের সমস্যা হতে পারে।
৬. ওজন : ওজন হ্রাস বা বৃদ্ধি সিজোফ্রেনিয়ার একটি সাধারণ লক্ষণ। সিজোফ্রেনিয়া কেন হয়?
বিশেষজ্ঞরা বলেন- জেনেটিক বা বংশগতভাবে এই রোগ থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাবা, মা-এর কারো এই রোগ থাকলে সন্তানেরও হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
চিকিৎসকরা বলছেন জেনেটিক কারণে হয় ৮০ শতাংশ। বাবা- মা দুজনের এই রোগ থাকলে সন্তানের হওয়ার সম্ভাবনা ৪০গুণ বেড়ে যায়। জমজ বাচ্চার একজনের থাকলে আরেকজনের ঝুঁকি ৫০ গুণ বেশি থাকে। এ ছাড়া সন্তান মাতৃগর্ভে থাকার সময় কোন সমস্যা হলে বা জন্মের সময় কোন ক্ষতি হলে বা অক্সিজেনের অভাব হলে এই রোগ হতে পারে। চাইল্ডহুড ট্রমা, সেনসেটিভ পারসোনালাটি হলে তার সঙ্গে কোন ভয়াবহ ঘটনা ঘটলে ঐ ব্যক্তির এটা হতে পারে।
সিজোফ্রেনিয়া রোগ থেকে মুক্তির উপায়
সবসময় মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখা জরুরি। কিছু বিষয় অনুসরণ করলে মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে। সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির ভিটামিনের অনেক ঘাটতি থাকে। ভিটামিন ডি এর মতো অন্যান্য ভিটামিনগুলোর ঘাটতির কারণেও সিজোফ্রেনিয়া হতে পারে। এ ক্ষেত্রে, বিভিন্ন ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার বা পরিপূরক গ্রহণ সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ গুলো হ্রাস করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাছের তেল সেজোফ্রেনিয়া প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। গবেষকরা ১৩ থেকে ২৫ বছর বয়সী ব্যক্তি, যাদের ভেতর মাত্র সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, এমন ৮১ জনের ওপর মাছের তেলের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করেন। মাছের তেলে থাকা ওমেগা-৩ অ্যাসিড মস্তিষ্কের জন্য ভালো বিষয়টি কম-বেশি সবাই জানেন। নিয়মিত শরীর চর্চা করলে শরীর ভালো থাকে, যাদের মুড সুইং হয় তারা ব্যায়াম করলে ভালো উপকার পাবে। ব্যায়াম মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ কমাতেও সাহায্য করতে পারে। শরীর চর্চার অনেক উপকারিতা রয়েছে। শরীর চর্চা প্রত্যেক মানুষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি হজম শক্তি বৃদ্ধি করে। স্বাস্থ্য রক্ষা করে। মানুষের শরীর ও হাড়ের জোড়াকে মজবুত করে। শরীর চর্চা করলে মস্তিষ্ক থেকে নানা রকম রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়। এসব রাসায়নিক উপাদান চিত্ত প্রফুল্ল করে এবং শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি দেয়।
পুষ্টিকর খাবার
পুষ্টিকর খাবার খেলে শরীর ভালো থাকে। এতে মনের যত্ন নেয়া যায় ঠিকঠাক। কিছু খাবার রয়েছে যা এত বেশি পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ যে, এগুলোকে 'ব্যালেন্সড ফুড' বলা হয়। অর্থাৎ এগুলো আমাদের দেহের বেশিরভাগ পুষ্টির যোগান দিতে সক্ষম। বিশ্বের ১০০০টি খাবারের মধ্য থেকে সবচেয়ে বেশি পুষ্টিগুণ রয়েছে এমন ১০০টি খাবারের তালিকা করেছেন যুক্তরাজ্যের গবেষকরা। তাই খাওয়ার সময় আমাদের পুষ্টি চিন্তা করে খেতে হবে।
পর্যাপ্ত ঘুম
কথায় বলে খাওয়ার উপরে ঘুমের অবস্থান। অর্থাৎ ঘুমটা ভীষণ জরুরী শরীরের জন্য। গবেষণা বলছে, কম ঘুমের কারণে কমছে মানুষের আয়ু। এ কারণে সুস্থ থাকা এবং দীর্ঘ জীবনের জন্য ভালো ঘুমের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান বিষয়ের অধ্যাপক ম্যাথিউ ওয়াকারের মতে, দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনযাপন করার জন্য রাতের ভালো ঘুমের জন্য বিনিয়োগ করা উচিত। তবে এই ঘুম হতে হবে স্বাভাবিক, ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুম নয়।
নেশাজাতীয় দ্রব্য পরিহার
অ্যালকোহল এবং ড্রাগ মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থাকে খারাপ করে দেয়। সুস্থ থাকতে হলে এগুলো পরিহার করতে হবে। নেশা জাতীয় দ্রব্য শরীরে উপস্থিত অ্যান্টিবডি ধ্বংস করে। অ্যান্টিবডি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উৎপন্ন প্রোটিন যেগুলো শরীরে প্রবেশক্রিত ভাইরাসকে ধ্বংস করে। অ্যান্টিবডি ধ্বংসের পাশাপাশি ফুসফুসের কার্যক্ষমতাও কমিয়ে দেয়। সুতরাং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রাখতে অবশ্যই অ্যালকোহল, ধূমপান, মদ্যপান, তামাকজাত দ্রব্য পরিহার করা লাগবে।
সুন্দর সময় কাটান
যাদের সঙ্গে থাকলে আপনার মন ভালো থাকে তাদের সঙ্গে সময় কাটান। সমস্যা অনেকটাই দূর হবে। আর আমরা যখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকি, তখন কোনো কিছুতেই আনন্দ খুঁজে পাই না। একটুতে চোখ ভিজে আসে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়; নৈরাশ্যও ভর করে। বিষণ্ণতায় মন খারাপের মাত্রা অনেক তীব্র ও স্থায়িত্বও তুলনামূলক বেশি। তাই মন ভালো রাখতে সুন্দর সময় কাটান। সিজোফ্রেনিয়া থেকে মুক্তি পেতে এটা ভালো উপায়।