গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার ১০০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অব্যস্থাপনায় স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এই অবস্থার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতা ও অদক্ষতাকে দায়ি করেছেন ভূক্তভোগিরা। গত রোববার সকালে সরেজমিনে কোটালীপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সর লেবার ওয়ার্ডে কথা হয় আখি ঢালীর সাথে।তার বাড়ি উত্তর কোটালীপাড়ার জহরেরকান্দি গ্রামে। শুক্রবার সকালে গর্ভকালীন জটিলতা ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা নিয়ে কোটালীপাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন। আখির স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা যায়, অজ্ঞান অবস্থায় উইল চেয়ারে করে তাকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়। তিন দিন অতিবাহিত হলেও কোন ডাক্তারের সাক্ষাত পাননি বলে অভিযোগ তাদের। শারীরিক অবস্থার কোন উন্নতি না হয়ায় বাধ্য হয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেসে অবস্থান করছেন এবং হাসপাতালের বাইরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. ঝুমা পালের অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছেন। একই অভিযোগ করেছেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের লেবার ওয়ার্ডে ভর্তি কোটালীপাড়ার শুয়াগ্রামের চম্পা মজুমদারের স্বামী বিভূতি বল্লভ। এদিকে, রোববার দুপুর সোয়া ১ টার দিকে সাংবাদিক আসার খবর পেয়ে গাইনি ওয়ার্ডে ছুটে আসেন দায়িত্বপ্রাপ্ত গাইনী বিশেষজ্ঞ জুনিয়র কনসালন্টেট ডা. রাজিব রায়। কিন্তু কোন দায়িত্ব পালন না করেই সাংবাদিকদের এড়াতে তিনি সেখান থেকে দ্রুত সটকে পড়েন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বর্তমানে ২৪ জন চিকিৎসক কর্মরত রয়েছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন (জুনিয়র কনসালটেন্ট) কার্ডিওলজি, চর্ম ও যৌণ, গাইনি অ্যান অবস, শিশু ও অ্যানেস্থেশিয়ার। এ ছাড়া রয়েছেন একজন ডেন্টাল সার্জন। এরমধ্যে একজন চিকিৎসককে (জুনিয়ার কনসালটেন্ট মেডিসিন) ডেঙ্গু কালীন সময়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন হাসপাতালে প্রেষণে পাঠানো হয়। রোববার সরেজমেিন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেখো যায় মাত্র ৫-৬ জন চিকিৎসককে রোগী দেখার কাজে নিয়োজিত থাকতে দেখা যায়। রোগীর চাপ থাকায় ওইসব চিকিৎসকদের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রেখে চিকিৎসা দিতে বেগ পেতে হচ্ছিল। বাকি চিকিৎসকদের বিষয়ে জানতে চাইলে এবং তাদের ডিউটি রোস্টার ও ডিজিটাল হাজিরা তালিকা দেখতে চাইলে হাসপাতালটির প্রধান কর্মকর্তা ডা. নন্দা সেন গুপ্ত জানান, এগুলো সাংবাদিকদের দেখানোর এখতিয়ার নেই। তথ্যানুযায়ী জানা যায়, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সপ্তাহে দুই দিন ওটি করা হয়। জানুয়ারি মাসে ৯টি সিজারিয়ান অপরেশন ও ২৭টি নরমাল ডেলিভারি করা হয়। জনসংখ্যার অনুপাতিক হারে যা পাশ^বর্তী টুঙ্গিপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্র্য কমপ্লেক্সের অর্জন থেকে তুলনামূলক নি¤œমূখি। সাধারণ দরিদ্র রোগীরা হাসপাতালে ওটি’র সুযোগ পান না। সাধারনত বিশেষ শ্রেনীর মানুষ ও চিকিৎসকদের পরিচিতজনরা এ সুবিধা পেয়ে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেন্টাল ইউনিট তেমনভাবে কার্যকরি নেই। ডেন্টাল সার্জন ডাঃ নাজিয়া ইয়াসমিন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নতুন ভবনের যন্ত্রপাতিহীন একটি ফাঁকা কক্ষে বসে চিকিৎসা দেন। অথচ পুরাতন ভবনে দাঁতের চিকিৎসার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ একটি ডেন্টাল ইউনিট রয়েছে। যা বর্তমানে স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কোটালীপাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ দাড়িয়া অভিযোগ করে বলেন, ২০২৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটালীপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করেন। এরপর ধাপে ধাপে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ ও আধুনিক ইকুইপমেন্ট সরবরাহ করা হয়। ১০০ শয্যায় উন্নীত হওয়ায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আগের থেকে রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। কিন্তু সবকিছু থাকার পরও চিকিৎসকদের উদাসীনতার কারণে রোগীরা সেবা না পেয়ে বিভিন্ন ক্লিনিকে ও জেলা শহরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যারা আছেন তারা বাসা ও প্রাইভেট ক্লিনিকে প্র্যাকটিস নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। অনেক রোগী জানেন না, কোটালীপাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন। হৃদরোগের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছে- আমি নিজেও জানিনা। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সব ব্যবস্থা করলেও, এ যেন কাজির গরু কিতাবে আছে, কিন্তু গোয়ালে নেই এমন অবস্থা। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তার অদক্ষতাকে এজন্য দায়ি করেন তিনি। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অটোমেশন সিষ্টেম চালু থাকলে-তা পুরোপুরি কার্যকরি নেই। চিকিৎসকের দেওয়া প্রেসক্রিপসনের সাথে মিল রেখে কাউন্টার থেকে ওষুধ সরবারহ করা হয়না বলে রোগীরা জানায়। একযুগ আগের এনালগ মেশিনে নামে মাত্র করা হচ্ছে এক্স-রে। প্রায়ই সময় নষ্ট থাকে মেশিনটি। কোন রিপোর্ট দেওয়া হয়। রোগীদের ধরিয়ে দেওযা হচ্ছে এক্স-রে ফিল্ম। যা রোগীদের কোন উপকারে আসেনা। লোক দেখানোর জন্য এটা করা হয়। অথচ প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া পোর্টঅ্যাবল ডিজিট্যাল এক্স-রে মেশিন ৬-৭ বছর ধরে বাক্সবন্দী অবস্থায় রয়েছে। যা কোন কাজে লাগছে না। সনাতনি পদ্ধতিতে চলছে পরীক্ষা যাবতীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা। দু’জন টেকনোলজিষ্ট নিয়োগ থাকলেও একজনকে তার কক্ষে পাওয়া যায়। জানাগেছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনি এলাকার উন্নয়ন প্রতিনিধি শহীদ উল্লাহ খন্দকারের তৎপরতায় গত বছর হাসপাতালে একটি আধুনিক আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন প্রদান করে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ। যা দিয়ে রোগীরা সেবা পেতে শুরু করেছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ল্যাবে রক্তের গ্রুপ ও আরএইচ, এএসও টিটরে, ভিডিআরএল, এইচবি পারসেন্টটেজ, প্রেগনেন্সি টেষ্ট, ম্যালেরিয়া, এইচবিএসএজি, চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু পরীক্ষা চালু রয়েছে। দু’জন মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট নিয়োগ থাকলেও সাধারন ওইসব পরীক্ষা ছাড়া আর কোন প্যাথোলজি টেষ্ট করা হয় না। দেশের অন্যান্য স্বাস্থ্য কমপেক্সের মত কোটালীপাড়ায় সিবিসি, ইউরিন ফর পিটি, ইউরিন আর/ এম/ই এবং ক্রসমেসের মতো নরমাল প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা চালু করা সম্ভব বলে চিকিৎসা নিতে রোগীরা মনে করে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নতুন এই ভবনের চার তলায় গিয়ে দেখা যায়, পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ডে চারটি টি টয়েলেট রয়েছে। এরমধ্যে দুটিতে তালা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া একটি টয়েলেট নার্স ও স্টাফরা ব্যবহার করেন। সেখানে কোন রোগী যেতে পারে না। একটি মাত্র টয়েলেটে পুরুষ-মহিলা সবাইকে ব্যবহার করতে হয়। রাতে কারেন্ট গেলে অবস্থা আরো খারাপ হয়। অনেক মহিলারা পর্দা করে তারা পুরুষদের সাথে একই টয়েলেটে কিভাবে যাবে? তাই অনেক মহিলারা রোগী বাধ্য হয়ে হাসপাতালের বাহিরে কারো বাড়িতে যায়। এ ব্যপারে ডিউটিরত সিনিয়র স্টাফ নার্স বলেন, দুই মাস যাবত টয়েলেট দুটি বন্ধ রয়েছে। বিষয়টি ইউএইচপিও ম্যাডাম বলতে পারবেন। কোটালীপাড়ায় ১১টি উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ৮টি কেন্দ্রে চিকিৎসক পদায়ন আছে। কিন্তু ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পদায়নকৃত চিকিৎসকরা কখনও যান না। ইউনিয়নের কেউ কখনো ওই সব উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে ন্যুনতম কোন সেবা পাননা বলে তাদের অভিযোগ। উপজেলা স্বাস্থ্য পঃপঃ কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে চিকিৎসকরা কেবল মাত্র কাগজে কলমে কর্তব্য পালন করে যাচ্ছেন। নাম না প্রকাশের শর্তে একজন ইউপি চেয়ারম্যান অভিযোগ করে বলেন, পদায়নকৃত চিকিৎসকরা স্ব স্ব উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এসে চিকিৎসা দিলে অর্থ ব্যয় কষ্ট করে দরিদ্র অসহায় মানুষদের দূর দুরান্ত থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে চিকিৎসা নামে হয়রানির শিকার হতে হতোনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজ নির্বাচনি এলাকা কোটালীপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা সেবার এ দূরাবস্থার চিত্র বর্ণনা করে শেষ করা যাবেনা। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে কোটালীপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের একটি দৃষ্টিনন্দন আধুনিক ভবন নির্মিত হয়।গত বছর পুরাতন ভবন থেকে নতুন ভবনে প্রশাসনিক ও হাসপাতালের অধিকাংশ কার্যক্রম স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় অনেক ইকুইপমেন্ট ইনস্টল করা হয়নি। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়মিত ক্লিনার থাকার পাশাপশি আউট সোর্সিং কর্মী রয়েছে ১৬ জন। যাদের অধিকাংশ পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন। নতুন ভবনের ভিতরে প্রবেশের পর অপরিস্কার, অপরিচ্ছন পরিবেশ ও দূর্গন্ধে দম বন্ধের উপক্রম হয়ে যায়। দুপুরে ২টার দিকে সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে আকস্মিকভাবে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করেন নিয়োজিত পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। সরেজমিনে হাসপাতালটিতে ঘুরে দেখা যায় রোগীদের জন্য সরবরাহ করা হচ্ছে নি¤œ মানের খাদ্য। নি¤œমানের মোটা চালের ভাত, সিলভার কার্প মাছের ঝোল আর পাতলা ডাল রোগীদের দেওয়া হয়। হাসপাতালের ডিজিট্যাল হাজিরা মেশিন ১৫ মিনিট স্লো করে রাখা হয়েছে। কোটালীপাড়া উপজেলা স্বাস্থ ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ নন্দা সেন গুপ্তা বলেন, জনবল সংকটের কারণে কিছু সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যার বিষয়ে ইতোমধ্যে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। ডিজিটাল এক্স-রে মেশিনটি বাক্সবন্দী থাকার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের বিরুদ্ধে মামলার দুদকে মামলা চলমান থাকার কথা উল্লেখ করেন। রোগীদের অভিযোগ ও গণমাধ্যমের পর্যবেক্ষণ পাত্তা দিতে নারাজ তিনি।