এক সময় এখানে ছিল রাজা, রাজ্য ও রাজা রক্ষায় সৈন্যবাহিনী। রাজপ্রসাদ রক্ষার জন্য চারপাশে খনন করা হয়েছিল পরিখা। কিন্তু এখন রাজাও নেই,রাজ্যও নেই। রাজাকে বাঁচানোর জন্য নদীর সঙ্গে সংযোগ করে তৈরি করা হয়েছিল সুড়ঙ্গ। কিন্তু সেটিও মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। কালীগঞ্জ ঝিনাইদহ সড়কের নলডাঙ্গা গ্রামে এখন কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায় রাজার ৭ সুদৃশ্য মন্দির। প্রকৃতপক্ষে এই নলডাঙ্গা রাজপ্রসাদ আর রাজবংশের ইতিহাস কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে পাকিস্তান আমলেই। এখন রাজার স্মৃতি হিসেবে এই মন্দির গুলোই রয়েছে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। কালীগঞ্জ থেকে উত্তরে ৭ কিলোমিটার ও ঝিনাইদহ থেকে অন্তত ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে এই ঐতিহাসিক প্রাচীন রাজবাড়ির অবস্থান। পাকিস্তান আমলেই এ রাজবাড়ি কালের গর্ভে বিলীন হলেও বেগবতী নদীর ধারে বহুকাল ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কালীমাতা মন্দির, লক্ষী মন্দির,গনেশ মন্দির,দুর্গা মন্দির,তারামনি মন্দির,বিষ্ণু মন্দির,রাজেশ্বরী মন্দিরসহ সুদৃশ্য রয়েছে ৭ টি মন্দির। মন্দির সংস্কার কমিটির সাধারণ সম্পাদক জানান,মূলত তার ভাই অতুল অধীকারী ২০০৭ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব নিয়ে প্রতœতত্ত বিভাগ,ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় দানশীল, জনপ্রতিনিধি ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে পাওয়া প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে রাজার ৪টি মন্দির সংস্কার করা হয়। একটি মন্দির সংস্কার অর্ধেক হয়েছে, দ্বিতীয় তলার কাজ পুরো বাকি। আর বাকি ২টি মন্দির এখনো সংস্কার করা যায়নি। এখানে প্রতিদিন দেশ-বিদেশ থেকে এই রাজবাড়ি দেখতে আসেন শত শত নারী পুরুষ শিশু। স্থানীয়দের ভাষায় এটি নলডাঙ্গা মঠ বা নলডাঙ্গা রাজবাড়ি ও কেউ বলে মায়ের বাড়ি বলে পরিচিত। প্রশান্ত অধিকারী জানান, স্থানীয় লোকজন নিজেদের টাকায় ১৬৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী মায়ের মন্দিরসহ কালীমাতা মন্দির, লক্ষী মন্দির, তারা মন্দির, দ্বিতল বিশিষ্ট বিষ্ণু মন্দির অনেক টাকা ব্যায় করে সংস্কার করেন।স্থানীয় লোকমুখে ও ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায ৫০০ বছর আগে এই রাজবংশের আদি পুরুষ ভট্টরায় ফরিদপুরের তেলিহাটি পরগনার অধীন ভবরাসুর গ্রামে বসবাস করতেন। তারই এক উত্তরসুরী বিষ্ণুদাস হাজরা নলডাঙ্গার রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নবাবের চাকরি করে হাজরা উপাধি পেয়েছিল। তার পিতার নাম ছিল মাধব শুভরাজ খান। তিনিও নবাবের চাকরি করতেন। বৃদ্ধ বয়সে বিষ্ণুদাস ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগী হয়ে সন্ন্যাসী হন এবং ফরিদপুরের ভবরাসুর থেকে নলডাঙ্গার কাছে খড়াসিং গ্রামে চলে আসেন। বেগবতী নদীর তীরে এক জঙ্গলে তপস্যা শুরু করেন ও তার ভক্তবৃন্দদের ক্রমান্বয়ে ভীড় করতে থাকে।১৫৯০ সালে মোঘল সুবেদার মানসিংহ বঙ্গ বিজয়ের পর নৌকা যোগে বেগবতী নদী দিয়ে রাজধানী রাজমহলে যাচ্ছিলেন। তার সৈন্যরা পথিমধ্যে রসদ সংগ্রহের জন্য অনুসন্ধানে বের হয়ে বিষ্ণুদাস সন্যাসীকে তপস্যারত অবস্থায় দেখতে পান। এ সময় বিষ্ণুদাস সৈন্যদের খুব দ্রুত রসদ সংগ্রহ করে দেন। এতে সুবেদার মানসিংহ খুশি হয়ে সন্যাসীকে পার্শ্ববর্তী পাঁচটি গ্রাম দান করে যান। এই গ্রামগুলোর সমন্বয়ে প্রথমে হাজরাহাটি জমিদারি এবং ক্রমান্বয়ে তা নলডাঙ্গা রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন এলাকাটি নল-নটায় পরিপূর্ণ ছিল, তাই স্থানটি নলডাঙ্গা নামেই অভিহিত হয়। এরপর প্রায় ৩০০ বছর এ বংশের বিভিন্ন শাসক বিভিন্ন সময়ে রাজ্য শাসন করেন। বিভিন্ন শাসক বিভিন্ন সময়ে মন্দিরগুলো প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭০ সালে রাজা ইন্দু ভূষণ যক্ষা রোগে মারা গেলে তার নাবালক দত্তক পুত্র রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায় রাজ্যের দায়িত্বভার গ্রহন করেন। তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন আজকের এই বিলুপ্ত প্রায় কয়েকটি মন্দির যা কালের সাক্ষী হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বেগবতী নদীর তীরে।প্রকৃতপক্ষে রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায় ছিলেন বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার কুমড়াবাড়িয়া গ্রামের গুরুগোবিন্দ ঘোষালের কনিষ্ঠ পুত্র। তিনি রাজবংশের কেউ ছিলেন না। রাজা ইন্দু ভূষণ মারা যাওয়ার দীর্ঘ নয় বছর পর ১৮৭৯ সালে পূর্ণ জমিদারি ভার গ্রহন করেন রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায়। ১৯১৩ সালে তিনি রাজা বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত হন। সে সময় তিনি শিক্ষার প্রতি অনুরাগী হয়ে পিতা-মাতার নামে ইন্দু ভূষণ ও মধুমতি বৃত্তি চালু করেন যা তখনকার সময়ে এক বিরল ঘটনা ছিল। তিনিই ১৮৮২ সালে রাজবাড়ির কাছে আজকের সরকারি নলডাঙ্গা ভূষণ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি এখন কালীগঞ্জের প্রানকেন্দ্রে অবস্থিত। রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায় ১৯৪১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের কাশিতে মারা যান। কুমার পন্নব ভূষণ দেবরায় ও কুমার মৃগাংক ভূষণ দেবরায় নামে তার দুই পুত্র ছিল। ১৯৫৫ সালে এক সরকারি আদেশে অন্যান্য জমিদারীর মতো এই জমিদারীও সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং রাজবংশ শেষবারের মতো লোপ পায়। নলডাঙ্গা জমিদার বাড়ি প্রতিষ্ঠাতা বিষ্ণুদাস হাজরা প্রথমে ছিলেন একজন সন্ন্যাসি। তিনি ধর্মের প্রতি দুর্বল হয়ে এই সন্ন্যাসিনী জীবন বেচে নেন। তিনি তার ফরিদপুর জেলার বসতভিটা ছেড়ে বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ নলডাঙ্গা নামক এলাকায় এসে এক জঙ্গলে সন্ন্যাসিনী জীবনের তপস্যা শুরু করেন। আর এই সময়ে তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। তার তপস্যা করা অবস্থায় ওই জঙ্গলের পাশের নদী দিয়ে মোগল সা¤্রাজ্যের সুবেদার মানসিংহ তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে রাজধানীতে যাচ্ছিলেন। তখন তারা কিছু খাবার সংগ্রহ করার জন্য ওই জঙ্গলে প্রবেশকরে। তখন সৈন্যরা বিষ্ণুদাস হাজরাকে তপস্যারত অবস্থায় দেখতে পায়। তখন বিষ্ণুদাস তাদেরকে খাবার যোগাড় করতে সাহায্য করে। আর এতে খুশি হয়ে মোগল সুবেদার তাকে ওই জঙ্গলের আশেপাশের মোট পাঁচটি গ্রাম দান করে যান। আর এই থেকেই তার জমিদারীর শুরু। প্রথমত ওই জমিদারীর নাম ছিল হাজরা জমিদারী। পরে নলডাঙ্গা এলাকার নামানুসারে ওই জমিদারীর নামকরণ করা হয়। এরপর একের পর এক বংশ পরামপনায় এই জমিদার বংশধররা প্রায় তিনশত বছর ধরে এই জমিদারীর জমিদারী পরিচালনা করেন। তাদের শাসনামলে এখানে প্রায় আটটি মন্দির তৈরি করেছিল।