শুদ্ধি অভিযানের অংশহিসেবে দীর্ঘবছর ধরে বরিশালে থাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রায় পৌনে দুইশ’ সদস্যকে এবার ছাড়তে হচ্ছে বরিশাল। কনস্টেবল থেকে পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তারা আছেন এ তালিকায়। তাদের ৫০/৬০ জন চাকরির শুরু থেকেই রয়েছেন বরিশালে। কম করে হলেও ১৬/১৭ বছর আছেন অন্যরা। নানা কৌশলে বরিশালে থাকাই কেবল নয়; অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে কয়েকজনের বিরুদ্ধে। কেউ আবার জমি ও বাড়ি ক্রয় করে গড়েছেন সাম্রাজ্য। এমন ১৭৬ জনের তালিকা করেছে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ (বিএমপি)। তাদের স্বেচ্ছায় পছন্দমতো স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করতে বলা হয়েছে। এজন্য দেওয়া হয়েছে নির্দিষ্ট সময়। তারপর শুরু হবে বদলি প্রক্রিয়া। তবে বিষয়টিকে শুদ্ধি অভিযান আখ্যা দেওয়া হলেও কেউ মুখ খুলছেন না। পুলিশের চাকরিতে বদলি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া-এমনটাই বলছেন, বিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, চার থানা, চারটি ফাঁড়ি, ডিবি, সিটি এসবি ও পুলিশ কমিশনারের কার্যালয় মিলিয়ে বিএমপিতে কর্মরত সদস্যর সংখ্যা ১ হাজার ৭৩১ জন। তাদের মধ্যে সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) থেকে কমিশনার পদে ৫৯৬ জন কর্মরত রয়েছেন। বাকিরা নায়েক-হাবিলদার কিংবা কনস্টেবল। কাঠামো অনুযায়ী এরপরেও ৩৬৯টি পদ শূন্য রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএমপির দায়িত্বশীয় এক কর্মকর্তা বলেন, যাদের কথা বলা হচ্ছে তারা সবাই মাঠপর্যায়ে কর্মরত। আশপাশের জেলা কোঠায় নিয়োগ পেয়ে পোস্টিং নিয়েছেন বরিশালে। এরপর থেকে তারা বরিশালেই আছেন। দাপ্তরিক নিয়ম মানতে মাঝে মধ্যে তারা এক থানা থেকে আরেক থানায় যাচ্ছেন। এরপর ২/৪ মাসের জন্য ঘুরে আসেন ডিবি, এসবি অন্য জেলা অথবা আদালতে। ঘুরেফিরে তারা সবাই কিন্তু বরিশালেই থেকে যাচ্ছেন। এছাড়া বিয়ে করে বানিয়েছেন আত্মীয়ের দীর্ঘ তালিকা। নগরবাসীর কাছেও তারা ঘনিষ্ঠ পরিচিত। তাদের দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রায়ই বাঁধে জটিলতা। পরিচিত মুখ হওয়ায় দেখেই পালায় আসামি। আত্মীয়তা কিংবা পরিচয়ের সূত্রধরে অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টাও থাকে কারও কারও মধ্যে। এসব বিবেচনা করেই তাদের সরানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সূত্রে আরও জানা গেছে, আলোচ্য পৌনে দুইশ’ পুলিশ সদস্যর মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে রয়েছে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। তাদের মধ্যে নগরীতে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সুদৃশ্য ভবন রয়েছে পরিদর্শক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার। মাঝে কয়েকদিন অন্য জেলায় থাকা ছাড়া চাকরির শুরু থেকেই তিনি রয়েছেন বরিশালে। আরেকজন শিক্ষানবিশ উপ-পরিদর্শক পদে যোগ দেওয়ার পর থেকেই বরিশালে রয়েছেন। পরিদর্শক পদের এ কর্মকর্তা রয়েছেন একটি থানার দায়িত্বে। এছাড়া এক নিরস্ত্র পরিদর্শক আছেন চাকরির শুরু থেকেই। পিছিয়ে নেই উপ-পরিদর্শক (এসআই) পদের কর্মকর্তারাও। নগরীর জিয়া সড়কে ভবন, কলেজ অ্যাভিনিউ এলাকায় ফ্ল্যাট, রুইয়ার পোল এলাকায় জমি ও সিঅ্যান্ডবি রোডে প্লটের মালিক চার উপ-পরিদর্শক বরিশালে আছেন একযুগেরও বেশি সময় ধরে। এছাড়া এএসআই পদের এক কর্মকর্তা সদর উপজেলার চরকাউয়া এলাকায় অর্ধকোটি টাকারও বেশি মূল্যে ক্রয় করেছেন জমি। যিনি ১২/১৩ বছর ধরে রয়েছেন মেট্রোপলিটন পুলিশে। পাশাপাশি স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও ভাইয়ের নামে বিত্তের মালিক হয়েছেন বিভিন্ন পদমর্যাদার মাঠপর্যায়ের বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা। এরমধ্যে রয়েছেন বরিশাল কোট পুলিশের এক কর্মকর্তাও। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মেট্রোপলিটন পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, সঠিক পন্থায় অভিযোগ না আসায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না। এছাড়া দাপ্তরিক কিছু জটিলতাও রয়েছেন। তাই এই মুহুর্তে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে মেট্রোপলিটন পুলিশে শৃঙ্খলা ফেরানোর পাশাপাশি ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রাখা। এ কারণেই শুদ্ধি অভিযান শুরু করা হয়েছে। পুলিশ কমিশনার কার্যালয়ের আরেক কর্মকর্তা বলেন, বছর দুয়েক আগেও এরকম শুদ্ধি অভিযান চালানো হয়েছিল। ওইসময় এখানকার পুলিশ কমিশনারসহ মাঠপর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে বরিশাল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বরিশালের পুলিশ কমিশনার জিহাদুল কবির বলেন, বদলি পুলিশের একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। এটাকে ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করার সুযোগ নেই। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর সবাইকে নতুন জায়গায় বদলি করা হয়। পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি শাহাবুদ্দিন আহম্মেদ বলেন, পুলিশ প্রবিধান আর প্রভিশন এক নয়। এটা ঠিক যে একই কর্মকর্তা দীর্ঘদিন একই জায়গায় থাকলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে খানিকটা হলেও জটিলতা হয়। পাশাপাশি দীর্ঘসময়ে ওই কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ একটা বলয় তৈরি হয়। জেলা পুলিশের ক্ষেত্রে একটা নিয়ম আছে, নিজ জেলায় কোনো পুলিশ কর্মকর্তা চাকরি করতে পারবেন না। মেট্রোর ক্ষেত্রে বিষয়টি জটিল। তবু আমি মনে করছি, সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন প্রশ্নে একই স্টেশনে কোনো কর্মকর্তার যেমন তিন বছরের বেশি থাকা উচিত নয়; তেমনই তাকে রাখাও উচিত নয়।