টনিক ব্যবহার করে ড্রাগন বড় করার প্রচারনায় বিপাকে পড়েছেন কালীগঞ্জ উপজেলার ড্রাগন বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা। স্বাভাবিক নিয়মে চাষাবাদ করেও প্রচারনার বিরুপ প্রভাব ঠেকাতে না পারায় নিরুপায় হয়ে পড়েছেন এসব উদ্যোক্তারা। যা আর্থিক ক্ষতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে কৃষি উদ্যোক্তাদের।গত বছরের শেষের দিকে লাভজনক ড্রাগন ফল চাষে বড় রকমের আঘাত আসে। ইউটিউব,ফেসবুকসহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ড্রাগন নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা হয়। ফল বিক্রি নিয়ে বিপাকে পড়েন আড়ৎদার ও চাষীরা। অনেক চাষীর ফল ক্ষেতেই নষ্ট হয়।এ বছরে ফল বিক্রি ও বাজার কেমন যায় সেদিকে তাঁকিয়ে রয়েছেন কালীগঞ্জ উপজেলার কয়েকশত কৃষি উদ্যোক্তা। কথাগুলো বলছিলেন ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার আড়পাড়া গ্রামের তরুন কৃষি উদ্যোক্তা সোহরাব হোসেন শিহাব। উদ্যোক্তাদের রক্ষায় সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রয়োজনীয় গবেষণা করে ড্রাগন চাষাবাদের সুর্নির্দিষ্ট নির্দেশনা চান বাগান মালিক ও এর সাথে সম্পৃক্ত মানুষেরা। কালীগঞ্জ উপজেলায় কৃষি উদ্যোক্তারা ১৬৫ হেক্টর জমিতে ড্রাগন আবাদ করেছেন। এ বছরে বিনিয়োগ করেছেন লাখ লাখ টাকা। প্রথম পর্যায়ের ড্রাগন ধরা শুরু হলেও কাঙ্খিত বাজার মিলছে না। অনেক উদ্যোক্তা বিনিয়োগ করে কৃষি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। এসব উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নুতন ব্যবসার পথ খুলে দিয়েছে। একই সাথে পুষ্টিকর এই বিদেশি ফল হাতের নাগালে পাচ্ছেন ভোক্তারা। শিহাব বলেন,‘আমাদের কিছু সংখ্যক ড্রাগন চাষী ছোট ফল বড় করতে গত দুই বছর ধরে ইন্ডিয়ান একটি টনিক ও পরবর্তীতে দেশীয় ভাবে তৈরী টনিক ব্যবহার করেন। এতে ফলের আকার ও ওজন বৃদ্ধি পেলেও স্বাদ ও রঙ নষ্ট হয়ে যায়। টনিক ব্যবহারে লাল কালারের ফলগুলো লাল-সবুজ ও হলুদ কালারে পরিণত হয়। কিছু কিছু ফল উদ্ভট আকৃতির হয়। এ নিয়ে এক শ্রেণির ইউটিউবার ও ফেসবুকাররা ড্রাগন ফল নিয়ে সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণে ভিডিও কন্টেন্ট তৈরী করে। দুই একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় অন্যরাও ভিউ পেতে শত শত ভিডিও তৈরী করেন যার অধিকাংশই নেতিবাচক। যদিও কৃষি গবেষণা অধিদপ্তরের কর্তা ব্যাক্তিরা বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট করেন যে, নির্দিষ্ট মাত্রায় হরমোন ব্যবহার সারা বিশ্বেই স্বীকৃত। এছাড়া ওই সকল ফলের ল্যাবটেস্টেও ক্ষতিকর পদার্থের উপস্তিতি পাওয়া যায়নি। তারপর ড্রাগনে ভোক্তা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। পাইকারী বাজারে বড় আকারের ফলএ বছর ফল বিক্রি বেশ আতংকে রয়েছেন ড্রাগন চাষীরা। কালীগঞ্জ উপজেলার বানুড়িয়া গ্রামের অপর এক কৃষি উদ্যোক্তা মিজানুর রহমান জানান, ‘২০২২ সালে ছোট ফল বড় করতে চাষীরা যখন ড্রাগনে টনিকে ব্যবহার শুরু করেন তখনই আগামীতে ড্রাগন চাষে বড় রকমের ধাক্কার আঁচ করি। আমি টনিকে না গিয়ে হাঁটলাম ভিন্ন পথে। ফল বড় করতে ও স্বাদে বৈচিত্র আনতে সমাধান খুঁজলাম জাতে। জাত সংগ্রহের কাজটি সহজ করে দেয় আমার ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজ কৃষি ভাই। আমার এই দুই প্লাটফর্মে দেশের মানুষের পাশাপাশি যুক্ত আছেন অনেক প্রবাসী ভাইয়েরা যারা দেশকে ভালোবেসে নিরবে সবুজের বিস্তরণ ঘটাচ্ছেন দীর্ঘ দিন ধরে। এমন দুইজন অস্ট্রেলিয়ান প্রবাসী আমার পাশে দাঁড়ান। তারা হলেন মোহাম্মদ মাসুম মাহমুদ ও আরিফুর রহমান। একদিন ম্যাসেঞ্জারে কল দিয়ে আরিফ ভাই বলেন, কৃষি নিয়ে আপনার ভিডিও কন্টেন্ট গুলো আমি নিয়মিত দেখি। টনিক ব্যবহারে ড্রাগন চাষে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে শীর্ষক আলোচনাও আমি শুনেছি। বিভিন্ন জাতের ড্রাগন চাষই এর সমাধান হতে পারে। কথা শেষে তিনি ড্রাগনের নামের লম্বা একটি লিস্ট পাঠান। আমাদের দেশে যেমন বিভিন্ন জাতের আম আছে ঠিক তেমনি ড্রাগনের বিভিন্ন জাতের নাম দেখি। আরিফ ভাইকে অনুরোধ করি কয়েকটি জাতের ড্রাগনের চারা পাঠাতে। তিনি বলেন দেশে আমার বাড়ির ছাদে কয়েক জাতের ড্রাগন আছে আপনার জন্য কাটিং পাঠাচ্ছি। তিনি ট্রিশ রেড, ওবান’স ডটার, অজি গোল্ড, ক্যাথিভান অরামসহ আরও কয়েকটি জাতের ড্রাগন কাটিং পাঠান। আরিফ ভাইয়ের আগে পরিচয় হয় মাসুম ভাইয়ের সাথে তিনি মূলত সাইট্রাস নিয়ে কাজ করেন। তারপরও তাকে ড্রাগনের কিছু কাটিং সংগ্রহ করে দিতে অনুরোধ করি। তিনি আমাকে অস্ট্রেলিয়ার দুইটি বাণিজ্যিক জাত কলম্বিয়ান সুপ্রিম রেড ও ট্রিশিয়া হাইব্রিড গিফট করেন। এপর থেকে বিভিন্ন জাতের ড্রাগনের কাটিং সংগ্রহের কাজ অব্যাহত থাকে।’ উদ্যোক্তা মিজান আরো বলেন, মধুবন কৃষি খামারে বর্তমানে ৪০টির বেশি জাত আছে। যেগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি জাত আছে যেগুলোর ফল কোন প্রকার টনিক স্প্রে ছাড়াই ৪০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ওজনের হবে। গত বছর দুই একটি জাতে ফলন পেলেও এ বছরে অধিকাংশ জাতেই ফলনের আশা করছেন তিনি। এছাড়া বিভিন্ন জাতের ড্রাগন ফল স্বাদে ভিন্নতা আনবে। ফলে টনিক ব্যবহার নিয়ে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান হবে এবং ভোক্তারা আবার ড্রাগনে ফিরবে এমনটি আশা করছেন তিনি। পুষ্টিকর এই ফল খাওয়া থেকে কেউ মুখ ফিরিয়ে না নিয়ে, কৃষকের পাশে থাকতে অনুরোধ জানান উদ্যোক্তা মিজান। জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগের মাধ্যমে চাষাবাদ করা হচ্ছে এসব উদ্যোক্তাদের বাগানের ড্রাগন। প্রয়োগ করা হচ্ছে দেশীয় অনুমোদিত কীটনাশক। তবে জাতভেদে ড্রাগনের আকার আকৃতির ভিন্নতা থাকলেও তা নেতিবাচক প্রচারনায় আটকে যাচ্ছে ভোক্তাদের কাছে। কয়েকটি জাত আছে যা বিদেশ থেকে আসা। এ জাতগুলো হাইব্রিড নামে পরিচিত। এর ফল আকারে দেশীয় ছোট ফলের চেয়ে বেশ বড় হয়। যারা ড্রাগনে হরমোন ব্যবহার করে বড় করছেন তা চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক। সবাইকে সন্দেহের মধ্যে ফেলে দিলে তো এ খাতে কেউ বিনিয়োগ করবেন না। এ ব্যাপারে কথা হয় কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহবুব আলম রনির সাথে। তিনি জানান, এবছর কালীগঞ্জ উপজেলায় প্রায় ১৬৫ হেক্টর জমিতে ড্রাগন চাষ রয়েছে। চাষীরা যাতে টনিক ব্যবহার না করে সে ব্যপারে তাদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। সম্প্রতি ঝিনাইদহ জেলা ড্রাগন চাষী কল্যাণ সমিতির সদস্যরাও টনিক বর্জনের ঘোষনা দিয়েছেন। দেশে ড্রাগন উৎপাদন চাহিদার তুলনায় বেশি হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন ড্রাগন চাষ মূলত ঝিনাইদহ জেলায় বেশি হচ্ছে অন্য এলাকায় এ ফলের চাষ খুবই কম হয়ে ধাকে। তাই এমন আশংকার কথা তিনি ভাবছেন না। ড্রাগন চাষে আধুনিক চাষ পদ্ধতি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধকরণ ও রোগবালাই দমনে উপজেলা কৃষি অফিস চাষীদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করে করছেন।