কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের ৫টি গ্রামের কৃষকদের চোখে মুখে আতংকের ছাপ এখনো কাটেনি। এখনো পানবরজের ধ্বংশ স্তুপের নীচে পুড়ে যাওয়া ভাগ্য খোঁজার চেষ্টা করছেন। আগুনের লেলিহান শিখায় চোখের সামনেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে স্বপ্ন। বেঁচে থাকার স্বাদটাই যেন এখন বিষাদে ভরে গেছে। এমন অসহায়ত্ব অবস্থায় ঘুরে দাঁড়ানোর পথ ছাড়া কোন উপায় নেই। কারন তাদের এটাই মূল পেশা। পুড়ে যাওয়া ক্ষত থেকেই নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন কৃষকরা। মাটিতে পুড়া গন্ধ না শুকালেও জমি থেকে পুড়ে যাওয়া বাঁশ, পাটকাঠি আর ধ্বংশস্তুপ সরিয়ে নিয়ে নতুন করে পান বরজ তৈরীতে মনোনিবেশ করছেন অনেক কৃষক। অনেকেই পান বীজ সংগ্রহ করার চেষ্টা করছেন। এ অবস্থায় প্রয়োজন প্রচুর টাকার। কিন্তু টাকার কোন ব্যবস্থা নেই। আওয়ামীলীগের যুগ্ন সাধারন সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ ৪% হারে কৃষি ঋনের ব্যবস্থা করে দেবেন, এমন ঘোষনায় কিছুটা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন কৃষকরা। কৃষকরা চান দ্রুত অর্থ’র ব্যবস্থা হলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে তারা। ঘুরে দাঁড়াবে বাহাদুরপুর ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া অর্থনীতি। গত ১০ মার্চ সকাল ১১টার দিকে রায়টা পাথরঘাট এলাকা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। মুহুর্তেই আগুনের লেলিহান শিখা পুড়িয়ে ছাই হয়ে যায় ইউনিয়নের ৫টি গ্রামের সহস্রাধিক হেক্টর জমির পান বরজ, ফসলি জমি এবং বসতবাড়ি। ফায়ার সার্ভিসের ৯টি ইউনিট, পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় গ্রামবাসীর নিরন্তন প্রচেষ্টায় সাড়ে ৫ ঘন্টার প্রচেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রনে আসে। নজিরবিহীন ক্ষতির কবলে পড়ে সহ্রসাধিক কৃষকরা। টাকার ব্যাংক খ্যাত পানবরজ চোখের সামনেই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে কৃৃষকরা। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে পরিবারের মা, ছেলে, মেয়ে এবং স্ত্রীরা। আগুনের কাছে এক অসহায় আত্মসমর্পনে স্তব্ধ হয়ে পড়ে পুরো এলাকার মানুষ। পানবরজ পুড়ার সাথে সাথে ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়েছে পুরো এলাকা। পানবরজের সাথে সম্পর্কিত কৃষি শ্রমিকরা মুহুর্তেই বেকার হয়ে যায়। কৃষকের পান কে ঘিরে গড়ে গড়ে উঠা কুচিয়ামোড়া পান হাটও এখন পান শূন্য। গত ১৪ মার্চ সকালে আগুনে পোড়া এলাকা পরিদর্শনে আসেন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক এহতেশাম রেজা। সাথে ছিলেন, ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আকাশ কুমার কুন্ডু, পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভেড়ামার সার্কেল মহসীন আল মুরাদ, ভেড়ামারা থানার অফিসার ইনচার্জ জহুরুল ইসলাম। এসময় কৃষকরা আকুতি জানিয়ে জেলা প্রশাসককে জানান, তারা কোন ত্রান সহায়তা চান না। চান না ১০ কেজি ১৫ কেজি চাউল। এ সহায়তার মাধ্যমে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। তারা চান বিনা সূদে ঋন। ১ বিঘা পানের জমি রেডি করতে জমির খাজনা সহ প্রায় ১ লক্ষ টাকা প্রয়োজন। এমন অবস্থায়, সব ধরনের সহাযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছিলেন জেলা প্রশাসক এহতেশাম রেজা। আর সার্বক্ষনিক কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার আকাশ কুমার কুন্ডু সহ পুলিশ প্রশাসন। গতকাল সোমবার সকালে সরজমিন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অনেক কৃষকই নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু করেছেন। নতুন করে পান বরজ করতে পোড়া বাঁশ ও খুঁটি সরিয়ে নিচ্ছেন। সেই খুটি বা বাতা ব্যবহার উপযোগী তা সরিয়ে রাখছেন। নতুন করে বাঁশ ও খড় দিয়ে ছাউনি দিচ্ছেন। পানের বরজই যে তাঁদের প্রধান অর্থকারী ফসল। এতেই তাদের সংসার চলে। যে কোন ভাবেই পানবরজ প্রস্তুত করতেই হবে। রায়টা এলাকার কৃষক রুহুল আমীন জানান, আমার ১ বিঘা জমিতে পান বরজ ছিল। খুব কষ্ট করে করেছিলাম। আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এখন নতুন করে করতে হলে অনেক টাকা প্রয়োজন। আমাদের এ অবস্থায় এনজিও গুলো ঋন দিতেও নানা জটিলতা সৃষ্টি করছে। মেঘনাপাড়া এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক শাহাজাহান আলী। ১৩০ পিলি পানের বরজ ছিল। আগুনে সব কিছুই শ্যাষ হয়ে গেছে। পুড়ে যাওয়া পান বরজেই নতুন বীজ লাগানোর জন্য ড্রেন করছেন। তিনি জানান, আমার মত বহু কৃষকই এখন নতুন করে পান বরজ তৈরীতে ব্যাস্ত সময় কাটাচ্ছেন। এ জন্য প্রয়োজন হচ্ছে বাঁশ, পাটকাঠি, সুতা, তার, বাতা, খড়। সুযোগ বুঝে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। যে পাটকাটি ১ মন কিনতাম ৩৩০ টাকা দিয়ে। এখন সেই পাটকাঠি কিনতে হচ্ছে ৫’শ থেকে সাড়ে ৫’শ টাকায়। এছাড়াও শ্রমিক সহ নানা কাজেই প্রয়োজন প্রচুর টাকা। তিনি জানান, ১৩০ পিলি পান বরজ নতুন করে করতে হলে প্রয়োজন ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা। পুড়ে যাওয়া পানবরজের বাঁশ, বাতা বাছাই করে ব্যবহার করবো, তাতেও খরচ হবে কমপক্ষে ১ লাখ টাকা। কিন্তু আমাদের কাছে তো টাকা নাই। এমন অবস্থায় সরকারী সহযোগিতায় দ্রুত ঋনের ব্যবস্থা হলে, আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর কাজটা সহজ হতো। এমন অবস্থা, মেঘনাপাড়া এলাকার লতিফ, শরিফুল, সাজুল, শফি, মহিউদ্দীন, রায়টার জালাল উদ্দীন সহ বহু কৃষকের। গত ১৬ মার্চ নগদ অর্থ এবং খাদ্য সহায়তা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের দৌড়গোড়ায় পৌছান মাহবুব-উল আলম হানিফ এবং কুষ্টিয়া-২ আসনের নবাগত সাংসদ কামারুল আরেফিন। সমাবেশে কুষ্টিয়ার একটি ঘটনা উল্লেখ করে জননেতা মাহাবুব-উল আলম হানিফ বলেন, আপনাদের দাবী একটাই স্বল্পসুদে কৃষি ঋনের ব্যবস্থা করে দেওয়া। আপনাদের এ দাবী খুব দ্রুতই আমি পূরন করে দেবো। যাতে আপনারা ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন। কৃষি কার্ডের মাধ্যমে ৪% সুদের হারে ঋন সহায়তার ব্যবস্থা আমি করে দেবো। ইতোমধ্যেই আমি কয়েকটি ব্যাংকের সাথে কথা বলেছি। এক ব্যাংকের প্রতিনিধি মাঠ পর্য্যায়ে জরিপের জন্য খুব দ্রুতই এখানে আসবে। এসময় কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসককে উদ্দ্যেশ করে বলেন, এনজিওদের কাছ থেকে ঋন নেওয়া কৃষকদের কাছ কোন কোন এনজিওই যেন আগামী ৬ মাসের মধ্যে ঋনের কিস্তি না নেয় তার ব্যবস্থা করবেন। বর্গা চাষীদেরকেও বলেন, কোন জুলাম করবেন না। প্রতি বিঘা ৩০/৩৫ হাজার টাকার স্থলে খাজনা কম করে নেবেন। কোন অবস্থাতেই ২০ হাজার টাকার উপরে নেবেন না। সহনশীল হয়ে কৃষকদের সহায়তা করুন যাতে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারে।