ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করে লাভবান হচ্ছেন চাষিরা। উপকূলীয় অঞ্চলে বিগত কয়েক বছর ধরে চিংড়ি উৎপাদন কমলে মৎস্য অধিদপ্তরের নির্দেশনায় দিঘলিয়ায় ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চাষ করে চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। খুলনা জেলার দিঘলিয়ার ব্রহ্মগাতী ও পানিগাতী গ্রামের পাশাপাশি উপজেলার যোগীপোল অঞ্চলে শিক্ষিত বেকারদের মাঝে নতুন উদ্যমে শুরু হয়েছে সম্ভাবনাময় ক্লাস্টার পদ্ধতির চিংড়ি চাষ । এর ফলে ক্লাস্টার পদ্ধতির এ চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষে উন্মোচিত হচ্ছে ব্যাপক কর্মসংস্থানের দ্বার। খুলনার দিঘলিয়া উপজেলা চিংড়িসহ মৎস্য চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। রয়েছে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ১৫৩২ চিংড়ি ঘেরসহ ৭৩৬৩ টি মৎস ঘের ও জলাশয়। কিন্তু পূর্বে সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার ফলে উৎপাদন খুবই কম হচ্ছিল। বিভিন্ন সময় রোগ বালাই সহ নানাবিধ কারণে চিংড়ির মড়কও দেখা দেয়। আবার উৎপাদন খরচ বেশী হওয়ায় চাষিদের লোকসানও গুনতে হয়েছে। ফলে দিনদিন দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় সাদাসোনা খ্যাত চিংড়ি চাষে আগ্রহ হারিয়ে চাষিরা ভিন্ন পেশায় চলে যান বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়। সূত্র জানায়, ভাইরাস, মড়ক, ন্যায্য মুল্য না পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে চিংড়ি চাষিরা যখন হতাশায় দিন পার করছে ঠিক তখনই মৎস্য অধিদপ্তর চাষিদের দেখিয়েছেন নতুন সম্ভাবনা ও আশার আলো। মৎস্য অধিদপ্তর ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের জন্য মৎস চাষিদের সংগঠিত করেন চিংড়ি চাষিদের (সিআইজি) সমবায় সমিতির মাধ্যমে। চিংড়ি চাষিদের নিয়ে ক্লাস্টার গঠন করা হয়। প্রতি ক্লাস্টারে ২৫ জন করে প্রথমে ১৩ টি ক্লাস্টার গঠন করলেও বর্তমানে এর সংখ্যা ১০ এ দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ৫ টি ক্লাস্টার সরকারি প্রণোদন পেয়েছে। বাকী ৫ টাও আগামীতে পাবে বলে উপজেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসার দিঘলিয়া মোঃ মঞ্জুরুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে জানান। ক্লাস্টার পদ্ধতির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তাদের মৎস্য খামারে শুধু চিংড়ি মাছই নয় সাথে কার্ফ জাতীয়সহ আরো দেশীয় মাছ চাষ করা হয় । বর্তমানে ব্রহ্মগাতী ও পানিগাতীসহ যোগীপোল অঞ্চলের ২ ৫০ জন চাষি (তন্মধ্যে ৫৮ জন নারী সদস্য ) প্রাথমিক অবস্থায় ১৫৩২ টি ঘের ও জলাশয়ে চিংড়ি চাষ করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। বর্তমানে দিঘলিয়ায় ৯৭২ জনসহ ৪৮৪২ জন চাষি মাছ চাষের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন। দিঘলিয়ার চিংড়ি চাষিরা এখন পর্যন্ত খাবার উৎপাদনে যেতে পারেনি। তারা বাজার থেকে খাবার কিনে ঘেরে ব্যবহার করছে। তবে খুলনার অন্যান্য উপজেলায় ক্লাস্টার চাষিরা খাবার নিজেরাই উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। পূর্বে যেখানে শতক প্রতি মাছের গড় উৎপাদন ছিল ২/১ কেজি। বর্তমানে ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চাষাবাদের ফলে শতক প্রতি গড় মাছের উৎপাদন দাঁড়িয়েছে গলদা, বাগদা ও কার্প জাতীয় মাছ ৪ কেজি যা ক্ষেত্র বিশেষে পূর্বের উৎপাদনের দ্বিগুনেরও বেশী। শুধু উৎপাদন বৃদ্ধিই নয় তাদের আয়ও বেড়েছে। ক্লাস্টার পদ্ধতিতে মাছ চাষাবাদ করার ফলে চাষিরা আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছেন, নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে, পারিবারিকপুষ্টির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি দিঘলিয়া অঞ্চলে দারিদ্র বিমোচনও ঘটছে। ফলে চিংড়ি চাষীদের মধ্যে নতুন প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হচ্ছে। ব্রহ্মাগাতী, পানিগাতী ও যোগীপোল অঞ্চলের চাষিদের দেখা দেখি উপজেলার আরো প্রায় আট শতাধিক চাষি চিংড়ি চাষ শুরু করেছেন। ৫৮ জন নারী চিংড়ি চাষি ক্লাস্টার পদ্ধতির চিংড়ি চাষের প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা অর্জন করেছেন। দিঘলিয়া ক্লাস্টারের রূপকার ও ক্লাস্টার সভাপতি মোঃ মনিরুল ইসলাম বলেন, সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ মঞ্জুরুল ইসলাম স্যারের পরামর্শে মাত্র ৬ জন চাষি নিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম। এ পদ্ধতি অনেক লাভ জনক ও নিরাপদ হওয়ায় বর্তমানে ১৫৩২ টি ঘের ও জলাশয়ে ৯৭২ জন চিংড়ি চাষী এ পদ্ধতি অনুসরণ করে চাষাবাদ করছেন। চাষের ক্ষেত্রে গুড এ্যাকুয়া কালচার প্রাকটিস ও ফুড সেফটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দল গত ভাবে চাষের উপকরণ সংগ্রহ, পোনা ক্রয় ইত্যাদি করার ফলে উৎপাদন খরচ বহুলাংশে কমেছে। নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য নিজেরা তৈরি করতে পারলে ব্যয় আরো কমবে। তাছাড়া জৈব নিরাপত্তা বজায় রাখায় ঘেরে কোন রোগ বালাইয়ের আক্রমনও নেইবলে তিনি এ প্রতিবেদককে জানান। দিঘলিয়া উপজেলার চিংড়ি চাষী সমবায় সমিতির সদস্য পিয়ারী বেগম জানান, ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চাষাবাদের ফলে জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে। একই জমিতে গলদা, বাগদা, রুই, কাতলা, পার্সে, তেলাপিয়া ইত্যাদি মাছের চাষ এবং পাড়ে প্রচুর পরিমাণে সবজি চাষ করা হচ্ছে। আমাদের এ সকল ঘেরে নিষিদ্ধ কোন ঔষধ বা কীটনাশক ব্যবহার না করায় উৎপাদিত পণ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। যার কারণে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে ঘেরের পণ্যের চাহিদা ও মূল্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদিকে একটি মহল বলছেন, আড়ংঘাটা, বারাকপুর ও গাজীরহাট ইউনিয়নে প্রচুর সম্ভবনা থাকা সত্বেও সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে কেউ ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষে এগিয়ে আসতে চাইছেনা। বিচ্ছিন্ন ভাবে কেউ কেউ চিংড়ি ও সাদা মাছ চাষ করলেও তারা যে পদ্ধতি ডুমুরিয়ার চাষিরা অনেক সাড়া জাগালেও দিঘলিয়ার কৃষকেরা পিছিয়ে। উল্লেখ্য, গত বছরে ও বর্তমান বছরে খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মূর্শেদী এমপি, মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এডিশনাল সচিব মোঃ আহমেদ আলী, মৎস্য অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মোঃ জাহাঙ্গীর আলমসহ উর্দ্ধতন কর্মকর্তাগণ দিঘলিয়া উপজেলার চিংড়ি চাষীদের ক্লাস্টার ও চিংড়ি ঘের সরেজমিনে পরিদর্শন করেন । পরিদর্শন শেষে এডিশনাল সচিব সিআইজি প্রকল্পের প্রসংশা করেন এবং দেশে চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ক্লাস্টার পদ্ধতির চিংড়ি চাষের এই মডেল সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশনা প্রদান করেন। ক্লাস্টার পদ্ধতির উপজেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসার মোঃ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ পদ্ধতিটি নিরাপদ চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধি, উপকূলীয় কৃষি ভিক্তিক অর্থনীতির উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং এসডিজি অর্জনের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করা। দেশের প্রতিটি ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণ সম্ভব হলে চিংড়ি সেক্টরে ব্যাপক উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মোচন হবে । পুনরায় অর্জিত হবে সাদা সোনার বৈদেশিক মুদ্রা।