সামনে আসছে বাঙালির প্রানের উৎসব পহেলা বৈশাখ। নানা ধরনের খেলনা আর পণ্যের সমাহার নিয়ে বসবে বৈশাখী মেলা। কোথাও কোথাও মেলা চলবে সপ্তাহ কিংবা পুরো মাস জুড়ে। আর মেলাকে সামনে রেখে সোলা দিয়ে নানান বাহারি রঙের কৃত্রিম ফুল তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন ৩০ জন মহিলা। অধিকাংশ মানুষের কাছে কালীগঞ্জের নরদহী গ্রামটি স্থানীয়দের কাছে ফুলগ্রাম হিসেবে পরিচিত। গ্রামের মহিলারা কৃত্রিম ফুল তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। সারা বছরই অবসর সময়ে এসব মেয়েরা ফুল তৈরি করে। তবে বৈশাখ এলেই তৃপ্তির হাঁসি ফুটে ওঠে চোখে-মুখে।
কর্মোদ্যোগী মহিলারা অবসর সময় কাটানোর কথা থাকলেও শ্রম আর মমতায় শোলা দিয়ে নানা ধরনের খেলনা আর ঘর সাজানোর জিনিসপত্র বানানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এসব জিনিস বিক্রি করে থাকেন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্তৃক বিভিন্ন মেলায়। এসব মহিলাদের কর্মদক্ষতায় এলাকার মানুষের কাছে রয়েছে বিশেষ পরিচিতি শোলার দক্ষ শিল্পী হিসেবেই তাদের কে চেনে-জানে। বর্ষাকালে বিলের মধ্যে অযত্ন-অবহেলায় জন্মায় জলজ উদ্ভিদ শোলা। জ্বালানি ছাড়া আর তেমন কোনো কাজে লাগে না এই শোলা। কিন্তু ঝিনাইদহ কালীগঞ্জে বর্ষাকালে এই শোলা সংগ্রহ করে সারা বছর শৈল্পিক কাজে ব্যবহার করে থাকেন। শোলার ওপরে খোসা ছাড়িয়ে সাদা অংশ দিয়েই যাবতীয় কাজ করে থাকেন। শোলা দিয়ে যেসব নান্দনিক জিনিস তৈরি করে থাকেন তা চোখে না দেখলে বিশ^াস করা দুরূহ ব্যাপার। শোলা দিয়ে তৈরি করছেন বিভিন্ন রকম ফুল, ফুলের মালা, মসজিদ, তাজমহল, মন্দির, ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি,পালকি,পাখির মধ্যে বলাকা,পায়রা,বাজপাখি, চড়ুই, টিয়া, শালিক, ঘুঘু, ময়ূর, বক, টুনটুনি, হাঁস, মুরগি, মাছ, কুমির, হরিণ, শেয়াল, বাঘ, টমটম ঘোড়ার গাড়িসহ ৪০ প্রকার খেলনা তৈরি করছে । শোলার শিল্পকর্ম এতটাই নিখুঁত যে, প্রতিটি কাজই যেন জীবন্ত মনে হবে। তা ছাড়া যেকোনো ডিজাইনের নমুনা তাদের কাছে এনে দিলে শোলা দিয়ে তৈরি করে দিতে পারেন। শোলা দিয়ে শখের পণ্যটি বানিয়ে এরপর পছন্দমতো রঙ করে থাকেন।
সাবিনা ইয়্সামিন,তুলি বেগম বলেন, সোলা দিয়ে নিজ ঘরের বারান্দায় বসে একসাথে হাতে তৈরি করছেন সোলার তৈরি ফুল ও খেলনা। নিজ পরিবারের কাজ প্রতিদিন করার পর তারা এই ফুল তৈরির কাজ করে ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা উপার্জন করেন। এ গ্রামে বর্তমানে ৩০ জন মহিলা সোলার ফুল তৈরি করে আয় করছেন। ২০০৪ সালে প্রথমে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার নরদহী গ্রামের অন্তত ৩০ জন মহিলারা সোলার ফুল তৈরি কাজ শুরু করেন। নদী,নালা,খাল,বিলে জন্মানো সোলা গাছ এই ফুল তৈরির প্রধান উপকরণ। শুকনো সোলা পরিমাপ মত কেটে রোল তৈরি করে ফুলের মাপ অনুযায়ি তা কেটে নিচ্ছে। এরপর হাতের সাহায্যে সুতা দিয়ে বেঁধে বিভিন্ন প্রকার ফুল তৈরি করছে। গ্রামীন মহিলাদের সুনিপন হাতে ৪০ প্রকার ফুল তৈরি হচ্ছে। মহিলাদের তৈরিকৃত সোলার ফুল "রিগ্যাল হ্যান্ডিক্রাফট এন্ড ড্রাই প্লওয়ার নামে করা হচ্ছে বাজারজাত। সোলার তৈরি সর্বাধিক চাহিদা সম্পন্ন বেলি, গোলাপ,চামেলি,লিলি,চন্দ্রমল্লিকাওশাপলা ফুল হাজার প্রতি ১২০০ ১৩০০,১৮০০,১৬০০,২০০০ ও ২৫০০ টাকা মুল্যে ঢাকা শহরের নিউমার্কেট, কলাবাগান ও মিরপুর এলাকায় পাইকারি হিসাবে বিক্রি করে।
নরদহী গ্রাম ঘুরে দেখা মেলে বাড়ির বারান্দা,আঙিনা ও বাড়ির বাইরের খোলা জায়গায় গাছের ছায়ায় মহিলারা বসে সোলা দিয়ে তৈরির কাজ করছেন খেলনা ও ফুল। পরিবারের নারীরা অবসর সময়েই এসব কাজে ব্যস্ত থাকে। গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ল গাছের ছায়ায়, বাড়ির উঠানে এবং বাড়ির বাইরের খোলা জায়গায় মহিলারা মিলে এক সঙ্গে বসে শোলা দিয়ে বাহারী ফুল তৈরি করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু করে মাস জুড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে বৈশাখী মেলা। এসব মেলায় বিক্রির জন্য বিভিন্ন স্থানের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বাহারি সব ফুল কিনে নিয়ে যান। সব মিলিয়ে প্রতি বছর কয়েক লাখ টাকার ফুল দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। উৎপাদন খরচের চেয়ে দিগুণ দামে এসব ফুল বিক্রি হয়। এই ফুল তৈরিতে পরিবারের নারীদের অবদান সবচেয়ে বেশি। মেয়েরা সাংসারিক কাজ শেষে অবসর সময়ে ফুল তৈরি করে। বৈশাখ মাসকে ঘিরে ফুল তৈরির জন্য পরিবারের বড়দের পাশাপাশি ছোটরাও ফুল তৈরিতে লেগে যায়। বর্তমানে কাঁচামালের অভাব, পর্যাপ্ত পুঁজি বনিয়োগ করতে না পারা,নতুন নতুন ক্রেতা সৃষ্টি করতে না পারা,কর্মীদের প্রশিক্ষনের অভাব,মালামাল সংরক্ষণের স্থানের অভাবসহ নানা সমস্যার কারনেসোলার ফুল তৈরি নারীদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেনি অদ্যবধি। গৃহবধু ইয়াসমিন খাতুন বলেন, ক্ষুদ্র কুটির শিল্পে আওতায় যদি আমাদের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা করা হতো তাহলে আমাদের গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামের নারীরা সোলার ফুল তৈরির মধ্য দিয়ে আত্মনির্ভরশীল হতে পারতো। কারখানার বর্তমান মালিক তোফায়েল হোসেন জানান, তারই ভগ্নিপতি শারীরিক প্রতিবন্ধী সিরাজুল ইসলাম তাদের গ্রামে ২০০৪ সালে গড়ে তোলেন এই সোলার কারখানা। যে কারখানা গোটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। নারী, কিশোর-কিশোরী মূল কারখানায় ও বাড়িতে বসেই ফুল তৈরী করছেন। তবে শারীরিক সমস্যার কারণে কারখানার প্রতিষ্ঠাতা অবসর নিয়েছেন। এখন তোফায়েল হোসেন এটার মালিক। তোফায়েল হোসেন জানান, সিরাজুল ইসলাম কলকাতায় থাকাকালে এই সোলা দিয়ে ফল তৈরীর কাজ শেখেন। এরপর তারই ইচ্ছাতে তোফায়েল হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে ২০০৪ ফুল তৈরীর কারখানা গড়ে তোলেন। নাম দেন রিগ্যাল হ্যান্ডিক্রাফস এন্ড ড্রাই ফ্লাওয়ার।
তোফায়েল হোসেনের বাড়ির কারখানা ছাড়াও বিভিন্ন বাড়িতে চলছে সোলা দিয়ে তৈরী ফুল তৈরীর কাজ। কারখানার কাজের জন্য আগে থেকেই সোলা সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। প্রথম বছর ৫ জনকে তারা ফুল তৈরীর প্রশিক্ষন দেন। কিভাবে সোলা কেটে আকর্ষনীয় সব ফুল ও ফুলের মালা তৈরী হয়। আনোয়ার হোসেন, জাহিদুল ইসলাম, রুনা পারভিন, ময়না খাতুন ও শাহনাজ পারভিনকে তিন মাস প্রশিক্ষন দিয়ে কর্মের উপযুক্ত করে তোলেন। পর্যায়ক্রমে নারী-পুরুষকে তারা প্রশিক্ষন দিয়েছেন। এই কাগজ দিয়ে রোল বানানো হয়। ফুল তৈরীর ক্ষেত্রে ম্রমিকরা ভিন্ন ভিন্ন পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন। তোফায়েল হোসেন জানান, কয়েকবার আন্তর্জাতীক প্রতিবন্ধী দিবসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মেলায় স্টল দিয়েছিল। জাতীয় পর্যায়ে পুরষ্কারও পেয়েছেন। তবে অর্থের অভাবে কারখানা বড় করতে পারেন নাই।
সোলার ফুল তৈরি ও বিপণনের সার্বিক দায়িত্ব পালনকারী তোফায়েল আহমেদ জানান, বর্তমানে স্থানীয় ভাবে ফুল তৈরির মূল উপকরণ সোলা পাওয়া না যাওয়ায় খুলনা ফরিদপুর ও মাগুরা থেকে বেশি দামের সোলা ক্রয় করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থ যোগান দিতে আমি হিমশিম খাচ্ছি। ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছি না। চাহিদা থাকার পরেও বর্তমানে এ ব্যবসায় বেশ মন্দা যাচ্ছে। মাসে ৬০ হাজার টাকার ফুল বিক্রি করে খরচ বাদে মাত্র ১৫ হাজার টাকা লাভ থাকছে। রাখালগাছি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মহিদুল ইসলাম মন্টু বলেন, প্রায় দুই যুগ ধরে আমার ইউনিয়নের নরদহী গ্রামের নারীরা সোলার ফুল তৈরির কাজের সাথে যুক্ত। ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক তাদের একটি দোচালা ঘর নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ দিয়েছেন। যেখানে তারা একসাথে বসে সহজেই ফুল তৈরির কাজ করতে পারবেন। সোলার তৈরি ফুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।