ঘড়ির কাটায় তখন বেলা এগারোটা। তীব্র যানজটে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেছে বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকার সদর রোড থেকে ফজলুল হক এভিনিউ, চকবাজার ও একে স্কুল সড়ক। একইসময় নগরীর নতুন বাজার থেকে নথুল্লাবাদ এবং সাগরদী পুল থেকে রূপাতলীতে তীব্র যানজট হওয়ার সংবাদ চারিদিকে। ঘটনাটি গত ২৩ মার্চের। একইদিন বিকেল পাঁচটার পর একটি এ্যাম্বুলেন্সকে ঘিরে নগরীর বাংলাবাজার পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার এলাকায় অসহনীয় যানজটে রোজদার মানুষের নাভিশ্বাস উঠে। কেউ কেউ মুখখিস্তি করে বলেন, নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক এলাকা থেকে ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালগুলোকে নিরাপদ পরিবেশে সরিয়ে নেওয়া জরুরি হয়ে পরেছে। নগরীর রূপাতলী থেকে সাগরদী বাজার এবং নতুনবাজার থেকে নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকা এখন প্রতিদিনের স্থায়ী যানজটের এলাকা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। গত ২৪ মার্চ সকালে নগরীর কাকলীর মোড়ে দেখা গেছে, বড় একটি খালি ট্রাক সরু সড়কের দু’পাশই আটকে দিয়েছে। এতে করে ওই এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এসময় ট্রাক চালকের পাশে বসা সিটি করপোরেশনের কর্মচারী পরিচয়ে এক ব্যক্তি রীতিমতো ট্রাফিক পুলিশের সাথে তর্কে জড়িয়ে পরেন। ওই ব্যক্তি বলছিলেন, এই পথে সিটি করপোরেশনের যান্ত্রিক শাখা আমানতগঞ্জে যাওয়ার জন্য আমাদের পারমিশন আছে। যদিও পরবর্তীতে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেছে, পরিচয় দেয়া ওই ব্যক্তি সিটি করপোরেশনের কেউ নন। কাকলীর মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, হঠাৎ করে তিনটি ট্রাক এই মোড়ে এসে কোনদিকে যাবে তা বুঝতে না পেরে এই সমস্যার তৈরি করেছে। এরকম অসংখ্য অবৈধ যানবাহন প্রবেশ করছে শহরে। এরা বড় বড় নেতাদের রেফারেন্স দিচ্ছে। এদের আটক করতে গেলে দুই-তিনজন নেতা ফোন করে রীতিমতো হুমকি দিচ্ছে। ট্রাফিক বিভাগের পরিদর্শক আব্দুর রহিম বলেন, সকাল থেকে কাকলীর মোড়ে তিনজন সার্জেন্ট থাকেন। তাদের নিষেধ উপেক্ষা করে পাঁচ টনের ট্রাক প্রবেশ করায় যানজটের তৈরি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ঈদ বাজারকে কেন্দ্র করে অসংখ্য অবৈধ যানবাহন শহরে ঢুকে পড়েছে। তাই আগামী কয়েকদিন যানজট নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হবে। গত ২৩ মার্চ বিকেল পাঁচটার পর পরই নগরীর বাংলাবাজার এলাকার বিশাল যানজট সামলাতে ছুটে এসেছিলেন পরিদর্শক (ট্রাফিক) আব্দুল লতিফ। তিনি রীতিমতো হিমশিম খেয়ে প্রায় আধাঘন্টার চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে আনেন পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কারণে সৃষ্ট যানজটের। মারাত্মক অসুস্থ রোগীকে নিয়ে আসা একটি এ্যাম্বুলেন্স সড়কের ওপর পার্কিং করে ট্রলিতে রোগীকে নামিয়ে নিতে গিয়ে এই দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়। ওই এলাকার আরশেদ আলী কন্ট্রাক্টর সড়কের একাধিক বাসিন্দারা জানিয়েছেন, প্রতিদিন পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের উদ্দেশ্যে আসা এ্যাম্বুলেন্সগুলো এভাবেই সড়কের উপরে রোগীকে নামিয়ে দিচ্ছেন। ফলে ওই এলাকায় প্রায়ই যানজট লেগেই রয়েছে। পপুলার সংলগ্ন রিফিউজি কলোনীর বাসিন্দারা বলেন, এ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অসংখ্য ডাক্তারের চেম্বার। তাই এখানে রোগীদের আসা-যাওয়া বেশী। এমন একটি বড় প্রতিষ্ঠান শহরের বাহিরে নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশে হওয়া উচিত। এলাকাবাসীর দাবী, শুধু পপুলার নয়; গুরুত্বপূর্ণ সড়কের উপর ও কাছাকাছি অবস্থান থেকে সব হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো সরিয়ে নেয়া হলে নগরবাসীর ভোগান্তি অনেকটা কমে যাবে। এ বক্তব্যে সহমত পোষন করেন, নগর চিন্তাবিদ কাজী মিজানুর রহমান, শাহ সাজেদা, বরিশাল সাহিত্য সংসদের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কেএসএ মহিউদ্দিন মানিক বীরপ্রতীকসহ অনেকেই। নগর চিন্তাবিদ কাজী মিজানুর রহমান বলেন, বৈধ বা অবৈধ কোনো তালিকাইতো আমাদের নেই। ঈদকে সামনে রেখে নগরীতে যানজট আরো বাড়বে এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু কতোটা সহনীয় পর্যায়ে থাকবে তা ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্ব। তিনি আরও বলেন, আমরা নগরীতে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে এক্সিলারেটর ব্রীজ নির্মাণের দাবি জানিয়ে অপেক্ষায় আছি। সিটি মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত নিজেই এসব প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করেছেন। তাই এ ব্যাপারে আমাদের এখন ধৈর্য্য ধরা ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। বরিশাল সাহিত্য সংসদের সভাপতি মহিউদ্দিন মানিক বলেন, ১৫ থেকে ২০টি তিন রাস্তার মোড় এবং চার-পাঁচটি চৌরাস্তা বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকায়। এসব গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে সু-শৃঙ্খল পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে পরিকল্পিত নগরায়ন ঘটাতে হবে। পাশাপাশি সিটি করপোরেশন এলাকার পরিধি বাড়াতে হবে। তা না হলে এই সংকট কাটবে না। তাই বরিশাল উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করা সবচেয়ে জরুরী হয়ে পরেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। পরিবেশ আন্দোলনের নেতা কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, নগরীর ৩৫/৪০টি পয়েন্টে ট্রাফিক পুলিশের কার্যক্রম থাকার কথা। সেখানে হাতেগোনা ৪/৫টি পয়েন্টে তাদের উপস্থিতি দেখা যায়। এখন ডিজিটাল বাংলাদেশে ট্রাফিক বিভাগেরও ডিজিটাল হওয়া জরুরী। তারা ড্রোনের মাধ্যমে যানজট প্রবল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। পাশাপাশি তিন ও চার রাস্তার মোড়গুলোর মধ্যে বিশেষ করে আমতলার মোড়, চৌমাথা, বটতলা ও চকবাজারের ফলপট্টি ও নতুন বাজারে স্থায়ী ট্রাফিক পুলিশ নিয়ন্ত্রণ জোন তৈরি করা জরুরী। নগরীর ৩১/৩২টি পয়েন্টে ট্রাফিক পুলিশ থাকা জরুরী স্বীকার করে একাধিক ট্রাফিক সার্জেন্টরা জানিয়েছেন, কনস্টেবলদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ও মোড়গুলোতে একজন ট্রাফিক কনস্টেবল দিয়ে নিয়ন্ত্রণ খুবই কঠিন। কম হলেও তিনজন প্রয়োজন। বরিশালে রয়েছে মাত্র ৭৯ জন কনস্টেবল। এখানে এখনও ৩৬টি পদ শূন্য। একই দশা ট্রাফিক সার্জেন্টদের। ৩৭ জনের কাজ করতে হচ্ছে ২৭ জন সার্জেন্টকে। সার্বিক বিষয়ে উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) এসএম তানভীর আরাফাত বলেন, নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে প্রতিদিন আট ঘন্টার প্রতি শিফটে ৩৫/৩৬ জন কনস্টেবল কাজ করছেন। স্বল্প সংখ্য সার্জেন্টদের মধ্যে নথুল্লাবাদ ও রূপাতলী, লুকাস পয়েন্টে তিন থেকে চারজন করে কনস্টেবল ও দুইজন করে সার্জেন্ট দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি টিআইদের এতটুকু শান্তি নেই। তাদের সারাক্ষণ টহলের ওপর থাকতে হয়। তিনি আরও বলেন, এতো অল্প সংখ্যক লোকবল নিয়ে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ ৩২টি পয়েন্ট নিয়ন্ত্রণ রাখা খুবই কঠিন। নগরীর আমতলার মোড়ে একজন সার্জেন্ট নিয়মিত থাকেন উল্লেখ করে ট্রাফিক বিভাগের এই কর্মকর্তা বলেন, শুধু কনস্টেবল রেখে লাভ নেই, কারণ সেতো মামলা দিতে পারেন না। আমাদের লোকবল সংকটের কারণে সব পয়েন্টে ট্রাফিক কনস্টেবল রাখা সম্ভবও হচ্ছেনা। অপরদিকে নগরীতে ইজিবাইক ও অটোরিকশা যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তাও বিপদজনক। আবার পদ্মা সেতুর সুফল ভোগ করতে ও ঈদকে সামনে রেখে বহিরাগত গাড়ির চাপও বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, সড়কের পরিধি বৃদ্ধি, ভবনগুলোতে গাড়ি পার্কিং এগুলো সিটি করপোরেশনের কাজ। আমরা যানজট ও দুর্ঘটনা নিরসনের জন্য বেশকিছু প্রস্তাবনা তাদের দিয়েছি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাত্র ৫৭ বর্গকিলোমিটারের বরিশাল নগরীতে মাত্র পাঁচ হাজার যানবাহন চলাচলের সক্ষমতা থাকলেও বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে চলছে অন্তত ৩৫ হাজার। এরমধ্যে প্রায় সাত হাজারের মতো সিএনজি ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বৈধতা থাকলেও অবৈধভাবে চলছে এরচেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। একই সাথে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে অবৈধ যানবাহন তৈরির গ্যারেজ। আর এসব গাড়ি সড়কে নেমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। পাশাপাশি সড়কের গুরুত্বপূর্ণ মোড়সহ যেখানে সেখানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করানোর কারণে তীব্র যানজট দেখা দিচ্ছে। এতে করে চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে নগরবাসীকে। নগরবাসীর দাবি, যানজট থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তি পেতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপের পাশাপাশি অবৈধ গাড়ি তৈরির কারখানা বন্ধ করতে হবে।