বিভাগের ঝালকাঠীর কাঠালিয়া উপজেলার মরিচবুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক হিসেবে ২০২৩ সালের ১ জুন থেকে কর্মরত রয়েছেন লিয়াকত আলী জমাদ্দার। এর আগে তিনি একই উপজেলার আওরাবুনিয়া মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক ছিলেন। কিন্তু গত ৯ মাস ধরে তিনি কোনো সরকারি বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। লিয়াকত আলী জমাদ্দার বলেন, আমি চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করেছি। যতোবার নিয়োগ হয়েছে, ততোবার নতুন করে এমপিও হয়েছে। কিন্তু গত ৯ মাস ধরে আমি কোনো বেতন ভাতা পাচ্ছিনা। আমার বাবা মারা গেছেন। আমি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না। আমার সন্তানের লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এর চেয়ে আর খারাপ কি হতে পারে, বলেই তিনি কান্নায় ভেঙে পরেন। শুধু লিয়াকত আলী জমাদ্দার একাই নন; বরিশাল বিভাগের ছয়শ’ বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কমপক্ষে দেড় হাজার শিক্ষক লিয়াকত আলীর মতোই বেতন-ভাতা না পেয়ে এখন চরম মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সমাজে শিক্ষক হওয়ায় লোক লজ্জায় তারা কাউকে কিছু বলতে পারছেন না। তাই এতোদিন মুখ বুঝেই এসব শিক্ষকরা অসহ্য যন্ত্রণা বুকে চেঁপে রেখেছেন। নলছিটি উপজেলার হাজী এমএ রশিদ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে নলছিটি পঞ্চগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ২০২২ সালের ৭ জুলাই বদলী হয়েছেন হুমায়ুন কবির। তখন থেকে অদ্যবর্ধি তিনি একটি টাকাও বেতন-ভাতা পাননি। হুমায়ুন কবির বলেন, নতুন প্রতিষ্ঠানে যোগদানের পর কোনো বেতন পাচ্ছি না। বিষয়টি উধ্বর্তন কর্মকর্তাদের অসংখ্যবার জানিয়েও কোন সুফল মেলেনি। বরিশালের মোফাজ্জেল হোসেন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সামিনা আফরোজ বলেন, আমাদের স্কুলের সাতজন শিক্ষক-কর্মচারী গত দুই বছর যাবৎ এমপিওভুক্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। উপ-পরিচালকের কাছে এমপিওভুক্তির ফাইল আটকে থাকায় আমরা গত ২ বছর যাবৎ বেতন-ভাতা পাচ্ছিনা। এখন আমরা সমাজে মুখও দেখাতে পারছি না। তিনি বলেন, উপ-পরিচালক শিক্ষকদের ফাইলগুলি ঠিক না করায় বাধ্য হয়ে ডিজি অফিসে ছোটাছুটি করে আমরা বিভাগের মাত্র ২২ জনের ফাইল ঠিক করতে পেরেছি। কিন্তু এখনও প্রায় দেড় হাজার শিক্ষক একই সমস্যার মধ্যে রয়েছি। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি বরিশাল আঞ্চলিক শাখার সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন বা স্কেল পরিবর্তন বিষয়ে ৩৮ ধরনের কাগজপত্র লাগে। ফলে এই প্রক্রিয়াটি জটিলতর রূপ নিয়েছে। তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে আবেদনগুলো বাতিল করায় শিক্ষকরা অসহায় হয়ে পরেছেন। তাদের বেতন-ভাতা আটকে রয়েছে। তিনি আরও বলেন, দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এই বিষয়টির সুরাহা হলেও বরিশাল বিভাগে এটি আটকে রয়েছে। অপরদিকে দেড় হাজার শিক্ষকের বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে ৩০ মার্চ দুপুরে বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন এমপিও বঞ্চিত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী বিভাগীয় কমিটির আহবায়ক আব্দুল জব্বার খান। এসময় বিভিন্ন উপজেলার শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে আব্দুল জব্বার খান বলেন, নলছিটি, কাঠালিয়া, বরিশাল সদর, পিরোজপুরের নেছারাবাদসহ বিভাগের বিভিন্ন উপজেলার ছয়শ’ স্কুলের ১৫শ’ শিক্ষক বেতন-ভাতা থেকে গত ৬ মাস থেকে তিন বছর পর্যন্ত বঞ্চিত রয়েছেন। তিনি বলেন, জুনিয়র পদ থেকে সিনিয়র পদ কিংবা এক স্কুল থেকে আরেক স্কুলে গেলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের বিভাগীয় উপ-পরিচালক আনোয়ার হোসেনের কাছে শিক্ষকদের ফাইল আটকে যাচ্ছে। তিনি শিক্ষকদের ফাইলগুলো দিনের পর দিন আটকে রাখেন। এমনকি তুচ্ছ কারণে ফাইলগুলো বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে হাইস্কুলের শিক্ষকরা চাকরি করলেও এমপিও থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তিনি বলেন, আমরা ঈদ পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। এরমধ্যে সকলের বেতন-ভাতা না আসলে ঈদের পর উপ-পরিচালকের কার্যালয় ঘেরাও সহ কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। অভিযোগের বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর বরিশালের বিভাগীয় উপ-পরিচালক আনোয়ার হোসেনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এমনকি ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো জবাব দেননি। তবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বরিশাল অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, হয়রানির বিষয়টি আমি জেনেছি। তবে উপ-পরিচালক আনোয়ার হোসেনের কাছে হাইস্কুলের এতো ফাইল আটকে আছে তা আমিও জানতাম না। একজন শিক্ষক পূর্বে বেতন ভাতা পেতেন। স্কুল পরিবর্তন, জুনিয়র থেকে সিনিয়র হিসেবে পদায়ন হলে তার বেতন ভাতা বন্ধ থাকবে, এটা কাম্য নয়। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করে দ্রুত সমস্যার সমাধানের জন্য জোর সুপারিশ করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন।