উৎসবমুখর পরিবেশে খুলনার পাইকগাছায় কপিলমুনি কপোতাক্ষ নদের ঘাটে ঐতিহ্যবাহী মহাবারুণীর স্নানোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার সকাল ৭টা ৫৩ মিনিটে শতভিষা নক্ষত্রযোগে কপিলমুনি কালীবাড়ী ঘাটে স্নান শুরু হয়। আর দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে স্নান শেষ হয়। প্রবাদ আছে, মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে গঙ্গার পবিত্র জল এই স্থানে প্রবাহিত হয়, বরুণ জলের দেবতা, বরুণের স্ত্রী বারুণী, বারুণীর আর এক নাম গঙ্গা। তাই বারুণী স্নান মানেই গঙ্গা স্নান। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এ বিশ্বাস মতে প্রতি বছর চৈত্র মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে কপিলমুনি কপিলেশ্বরী কালী মন্দির স্নান ঘাটে পালন করেন বারুণীর স্নানোৎসব। তবে নানাবিধ কারণে এবারো কোনো প্রকার মেলার আয়োজন ছাড়াই শুধুমাত্র স্নানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো বারুণী স্নানোৎসব। কপিলমুনি বারুণী স্নান ইতিহাস থেকে জানাযায়, প্রায় ৪শ’ বছরেও বেশি সময় আগে কপিলদেব নামে এক মুনি কপোতাক্ষের সুন্দরবন উপকূলীয় উপজেলার কপিলমুনি কালী মন্দির সংলগ্ন কপোতাক্ষ নদের তীরে তপধ্যানে মত্ত থেকে সিদ্ধিলাভ করেন। তার সিদ্ধিলাভের দিনেই সেই স্মরণাতীত কাল থেকে জনপদের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা কালী বাড়ী ঘাটে বারুণী স্নান করে আসছেন। কথিত আছে, কপিল দেবের এক ভাই জরাসন্ধ ১শ’ নৃপতিকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে নরমেধ যজ্ঞ শুরু করেন। এ লক্ষ্যে তিনি হত্যাকান্ড শুরু করলে তার বৈমাত্রেয় ভাই কপিল তাকে প্রশমনে ইশ্বরের সাহায্য প্রার্থনায় সিদ্ধিলাভের আশায় বিভিন্ন স্থানে তপধ্যান শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি কপিলমুনি কপিলেশ্বরী কালীবাড়ী স্নান ঘাট সংলগ্ন বটবৃক্ষের মূলে বসে তপধ্যান শুরু করেন এবং সিদ্ধি লাভ করেন। ঐসময় তিনি যে সকল স্থানে তপধ্যান করেছিলেন, সেই সকল স্থানে প্রতি বছর মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে হিন্দু সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বারুণী স্নানোৎসব পালন করে আসছেন। তাদের বিশ্বাস মতে, এই তিথিতে গঙ্গার জল এই স্থান দিয়ে প্রবাহিত হয়। এবং গঙ্গার জলে স্নান করলে সারা বছরের পাপ মোচন হয়। আর সেই লক্ষ্যে জনপদের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা স্মরণাতীত কাল থেকে স্নানোৎসব পালন করেন। তবে অনেকে মনে করেন, বরুণ জলের দেবতা, আর বারুণী তার স্ত্রী। তাকে তুষ্ট করতেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বারুণী স্নান করে থাকেন। তবে মতান্তর থাকলেও স্মরণাতীতকাল থেকে কপিলমুনি কপিলেশ্বরী স্নান ঘাটে পালিত হয়ে আসছে বারুণী স্নানোৎসব। এ ছাড়া স্নানোৎসবকে ঘিরে কপিলমুনিতে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বারুণী মেলা। মেলা উপলক্ষে একসময় যাত্রা, সার্কাস, পুতুল নাচ, নাগর দোলা, মৃত্যুকূপসহ চিত্ত বিনোদনের নানা পসরার সাথে বসত বিভিন্ন খেলনা, কাঠের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় নানা পসরায় সাজানো হতো মেলা। আসতো দূর-দুরন্ত থেকে মানুষ। তবে ১৪ বছর আগে থেকে স্থানীয়দের সমন্বয়হীনতা ও রাজনৈতিক অস্থীরতা, জায়গার অভাবসহ নানা সংকটে বন্ধ রয়েছে বারুণী মেলা। বারুণী মেলা চলত এক সপ্তাহ থেকে শুরু করে পক্ষ কাল কিংবা ১ মাস পর্যন্ত। বারুণী স্নান সনাতনীরা করলেও বাঙালি সংস্কৃতির সাথে মিলে-মিশে মেলা উদযাপন করতো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জনপদের সকল ধর্ম বর্ণের মানুষরা। কপিলেশ্বরী কালী মন্দির কমিটির সভাপতি চম্পক কুমার পাল জানান, কপিলমুনি মহা বারুণী স্নানের ইতিহাস সুদীর্ঘ ও পৌরানিক কাহিনী নির্ভর। মেলার ইতিহাস উদ্বৃতি দিয়ে তিনি জানান, দ্বাপর যুগে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে পুন্ড্র নগরের অধিপতি বসুদেবের ছেলে বাসুদেবের বৈমাত্রেয় ভাই কপিলদেব কপোতাক্ষ নদের কালীবাড়ী ঘাটের বটবৃক্ষমূলে দীর্ঘ তপধ্যানে মগ্ন থেকে সিদ্ধিলাভের সময় থেকে এখানে বারুণী স্নান অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কপিলমুনি ঐতিহ্যবাহী বারুণীমেলা ফিরিয়ে আনতে সংসদ সদস্য মো. রশীদুজ্জামান এর নিরন্তন চেষ্টা ছিল। তবে প্রশাসনের অনুমতি না পাওয়ায় মেলা ছাড়া বারুণী স্নানোৎসব শেষ হয়। ইতিমধ্যে কপিলেশ্বরী কালী মন্দিরের সভাপতি চম্পক কুমার পালকে সভাপতি কপিলমুনি ইউপি চেয়ারম্যান মো. কওছার আলী জোয়ার্দ্দারকে সাধারণ সম্পাদক, সাধন চন্দ্র ভদ্রকে কোষাধ্যক্ষ ও মাহমুদ আসলামকে মেলা কমিটির পরিচালক করে ১৫১ সদস্য বিশিষ্ট বারুণীমেলা উদযাপন কমিটি গঠন করা হয়। এব্যাপারে কপিলমুনি মেলার পরিচালক এম মাহমুদ আসলাম জানান, ২০১০ সালে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রনালয় যেকোন ধরনের মেলা বা বাণিজ্যিক আয়োজনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারী করে। এরপর থেকে মেলা আয়োজনে শুরু হয় মাঠ শূণ্যতা। যদিও এরপর দু’একবার ভিন্ন এলাকায় মেলার আয়োজন হলেও পরবর্তীতে রাজনৈতিক সমন্বয়হীনতাসহ নানাবিধ সংকটে মেলার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। শুধুমাত্র বারুণী স্নানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে ঐতিহ্যবাহী বারুণীমেলা। শনিবার সংসদ সদস্য মো. রশীদুজ্জামান বারুণী স্নানোৎসব পরিদর্শন করেন। এসময় সঙ্গী ছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান মো. কওছার আলী জোয়াদ্দার, উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক আনন্দ মোহন বিশ্বাস, সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান কৃষ্ণপদ মন্ডল ও সাধন চন্দ্র ভদ্র প্রমুখ।