পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিদের মধ্যে মারমা সম্প্রদায়ের প্রধান সামাজিক উৎসব সাংগ্রাই। নতুন বর্ষ বরনের এই উৎসবকে কেন্দ্র করে মারমা পাড়াতে বইছে সাংগ্রাই বা জল উৎসবের জোয়ার। গ্রামে গ্রামে পাড়া মহল্লায় এবছর যেন উৎসবে মাতোয়ারা হয় উঠেছে পাহাড়ের মানুষ। আর মারমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী সাংগ্রাই জল উৎসবের আয়োজনের মধ্যদিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠি সম্প্রদায়ের প্রধান সামাজিক উৎসব বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক, বিষু, বিহু শেষ হচ্ছে। তবে মারমাদের পানি খেলা মধ্যদিয়ে বৈসাবী উৎসব শেষ হয়ে গেলেও এর রেশ থেকে যায় প্রায় পুরো এপ্রিল মাস জুড়ে।
রাঙ্গামাটিতে উৎসবের শেষ দিনে মারমা সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীরা একে অপরকে পানি ছিটিয়ে দিয়ে পুরনো বছরের সব দুঃখ, কষ্ট, গ্লানি ধুয়ে-মুছে দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে সাংগ্রাই জল উৎসবে মেতে ওঠেন। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে কয়েক হাজার নারী-পুরুষ সমবেত হয়েছে।
রাঙ্গামাটি মারি স্টেডিয়াম মাঠে কেন্দ্রীয়ভাবে মারমা সংস্কৃতি সংস্থা (মাসস) আয়োজনে চলে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি। আর রাঙ্গামাটিসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মারমা সম্প্রদায় ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষেরা সমবেত হয়েছে সাংগ্রাই জল উৎসবে। আর সাংগ্রাই জলোৎসবকে ঘিরে এলাকায় বইছে আনন্দের বন্যা।
মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) দুপুরে রাঙ্গামাটিতে কেন্দ্রীয়ভাবে মারমা সংস্কৃতি সংস্থা (মাসস) আয়োজনে রাঙ্গামাটির মারি ষ্টেডিয়াম মাঠে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে পিতলের ধর্মীয় ঘণ্টা বাঁজিয়ে পানি খেলা উৎসবে আনুষ্ঠানিকতার সূচনা করেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি। এরপর ফিতা কেটে জলকেলির উদ্বোধনের পর মারমা যুবক যুবতিদের গায়ে পানি ছিটিয়ে জল উৎসবের শুভ সুচনা করেন, রাঙ্গামাটি সংসদ সদস্য ও বন, পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপি। গেস্ট অব অনার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াশিকা আয়েশা খান এমপি। জলকেলির পর বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মারমা শিল্পিদের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও মারমা সংস্কৃতি সংস্থা (মাসস) সভাপতি অংসুইপ্রু চৌধুরীর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন, সংরক্ষিত মহিলা সাংসদ জ¦রতী তঞ্চঙ্গ্যা, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ, রাঙ্গামাটি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সোহেল আহমেদ, বিজিবি রাঙ্গামাটি সদর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মোঃ আনোয়ার লতিফ খান, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান, পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ, দুদক রাঙ্গামাটির উপ-পরিচালক জাহিদ কামাল প্রমুখ।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি বলেন, বৈসাবী উৎসব পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন না। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এই উৎসব। এটা শুধু সাংস্কৃতিক উৎসব নয়। এটাতে ধর্মীয় অনুভুতিও জড়িত। এদিন মুরব্বীদের কাছ থেকে আশীর্বাদ চাওয়া হয়। তাই এটি সামাজিক সাংস্কৃতিক উৎসবের পাশাপাশি ধর্মীয় উৎসবও। তিনি আরো বলেন, জাতির পিতা স্বপ্ন দেখেছিলেন সকল ভাষাভাষী ও সকল ধর্মের লোক সম্প্রীতির সাথে বসবাস করবেন। তাঁরই সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে আজ সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হচ্ছে। আজকের এই জল উৎসব অনুষ্ঠান প্রমান করে আমরা শান্তি চাই সম্প্রীতি চাই ঐক্য চাই। সেটাই আজকে প্রমান হয়েছে। তাই দেশের কল্যাণেযা যা করার প্রয়োজন সবাই স্ব স্ব অবস্থান থেকে কাজ করার আহবান জানান তিনি।
গেস্ট অব অনার হিসেবে বক্তব্য দিতে গিয়ে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াশিকা আয়েশা খান এমপি বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী উৎসব সাংগ্রাইয়ের সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যবোধ ও স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে পাহাড়ে সবাই যেন ভালো থাকে। বিগত বছরের দুঃখ, গ্লানি, ব্যর্থতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে নতুন বছরকে বরণের মাধ্যমে আমরা যেন সবাই ভাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারি।
জল উৎসব উদ্বোধন করতে গিয়ে রাঙ্গামাটি সংসদ সদস্য ও বন, পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপি বলেন, সাংগ্রাই উৎসব শুধু মারমা সম্প্রদায়ের নয় এই উৎসব সকলের। এ উৎসব এ এলাকায় বসবাসরত সকল সম্প্রদায়ের উৎসবে পরিনত হয়েছে। এটাই হলো বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতার রূপ। আর এই ধরনের অনুষ্ঠান পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত সকল সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীকে ভ্রাতৃত্বের সর্ম্পককে আরো সুদৃঢ় করে তুলবে। এখন সময় এসেছে তা সকলের মধ্যে পৌছে দেওয়ার।
তিনি আরো বলেন, পাহাড়ে বসবাসরত মুসলমান, হিন্দু, চাকমা, মারমাসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যে সকল জাঁতি সত্তা রয়েছে তারা সকলেই বাংলাদেশের নাগরিক এক কথায় আমরা সবাই বাংলাদেশি। আমাদের মাঝে কোন ভেদাভেদ নাই। পার্বত্য চট্টগ্রামের সব ভাষাভাষি, সম্প্রদায়ের বিশ্বাসকে সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তাই এ অঞ্চলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ আর্থ সামাজিক উন্নয়নে যা যা করা প্রয়োজন তা করতে বর্তমান সরকার সব ধরণের সহযোগীতা করে যাচ্ছে। যার যার যে ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে আমাদেরকে সেগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে।
মারমারা পুরাতন বছরকে বিদায় আর নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে এই জল উৎসব করে থাকে। মারমা তরুণ-তরুণীরা কয়েকটি দলে অংশ নেয় পানি খেলায়। একে অপরকে পানি ছিটিয়ে পুরাতন বছরের যে গ্লানি, দুঃখ, অপশক্তিকে দূর করে ধুয়ে মুছে দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানায় এই জল উৎসবের মাধ্যমে। এটি মারমাদের প্রধান সামাজিক অনুষ্ঠান হওয়ায় পালন করা হয় জাঁকজমকভাবে। এই আনন্দে মেতে উঠে পাহাড়ের হাজারো মানুষ। ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয় অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও। আর মৈত্রী জল বর্ষণের মাধ্যমে পাহাড়ের মানুষ সারা বছর যাতে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারে এই প্রত্যাশা পাহাড়ের মানুষের।
এই উৎসবকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নর নারী ছাড়া ও কয়েক হাজার বাঙ্গালী নরনারী উপস্থিত থেকে এ উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। পাহাড়ী বাঙ্গালীর পদধুলীতে এক মহা মিলন মেলায় পরিণত হয় মারমা সম্প্রদায়ের সাংগ্রাই বা জল উৎসবে।