আজ ২৪ এপ্রিল বুধবার। ঢাকার সাভারের রানা প্লাজা ট্রাজেডি’র ১১ বছর। আজকের এইদিনে রানা প্লাজার ভবনের নিচে চাপা পড়ে চিরতরে দুই পা হারিয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন দিনাজপুরের ফুলবাড়ী গার্মেন্টশ্রমিক রেবেকা বেগম (২৮)। রেবেকা বেগম দুই পা হারিয়ে প্রাণে বেঁচে গেলেও মাসহ পরিবারের পাঁচজন হারিয়ে গেছেন রানা প্লাজার ভেঙ্গে পড়া ভবনের ইটপাথরের কংক্রিটের স্তূতের ভেতর। আজও যাদের কোনো হদিস মেলেনি।
ফুলবাড়ী উপজেলার ২নং আলাদিপুর ইউনিয়নের বারাইহাট চেয়ারম্যানপাড়া গ্রামের রাজমিস্ত্রি মোস্তাফিজুর রহমানের স্ত্রী গার্মেন্টস শ্রমিক রেবেকা বেগম। ১৭ বছর বয়সে তার মাসহ রানা প্লাজার গার্মেন্টেসে কাজ করতেন। ঘটনার দিন সকালে না খেয়েই মাসহ পরিবারের সাতজন প্লাজার দ্বিতীয় তলায় গার্মেন্টেসের কাজে যোগ দেন। কাজের এক পর্যায়ের হঠাৎ বিকট শব্দে ভবনটি ভেঙ্গে পড়ে। ওই কক্ষের দেয়ালের নিচে দুই পা চাপা পড়ে আটকা পড়েন রেবেকা বেগম। দুইদিন পর স্বেচ্ছাসেবীরা তাকে উদ্ধার করেন। রেবেকাসহ দুইজন প্রাণে বেঁচে গেলেও ভবনের নিচে চাপা পড়ে চিরতরে হারিয়ে গেছেন তার মা চান বানু, দাদি কোহিনুর ও ফুপু রাবেয়াসহ অন্য পাঁচজন স্বজন।
মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) সকালে সরেজমিনে উপজেলার রাবাই চেয়ারম্যানপাড়ার বাড়ীতে কথা হয় পঙ্গুত্ববরণকারী গার্মেন্টসশ্রমিক রেবেকা বেগমের সঙ্গে। রেবেকা বেগম বলেন, সকাল ৯টার দিকে বিকট শব্দে রানা প্লাজা ধসে পড়ে। ঘটনার পর জ্ঞান ছিল না। জ্ঞান আসলে দেখেন পায়ের ওপর সিমেন্টের বিম চাপা পড়েছে। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে এক বছর ধরে রেবেকার চিকিৎসা দেওয়া হয়। ওই সময় তার বাম পা কোমর পর্যন্ত ও ডান পা গোড়ালি পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়েছে। ওই রানা প্লাজার ভবন ধসের পর সরকারি ঘোষণা ছিল যেসব শ্রমিক শরীরের দুইটি অঙ্গ হারিয়েছেন তাদেরকে ১৫ লাখ এবং যারা একটি অঙ্গ হারিয়েছেন তারা ১২লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ পাবেন। কিন্তু রেবেকা বেগম শরীরের দুইটি পা হারালেও তাকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে অনুদান দেওয়া হয়েছে ১০ লাখ টাকা। রেবেকা বেগম একটি পা হারিয়েছেন সংশ্লিষ্টদের এমন ভুল তথ্যের কারণে রেবেকা সরকার ঘোষিত পুরোপুুরি অর্থ পাননি। তবে অনুদানের টাকা স্থায়ী আমানত হিসেবে ব্যাংকে রেখেছেন। সেই টাকা থেকে প্রতি মাসে যা পান তা দিয়ে কোনমতে সংসার চলছে। তাকে ও বাচ্চাদের দেখাশুনার জন্য তার স্বামী বাইরে কাজ করতে পারেন না। রেবেকা বেগম আরো বলেন, তার দুই’পায়ে চারবার করে আটবার ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে অপারেশন করতে হয়েছে। বর্তমানে দুইপায়ের হাড্ডি বের হয়ে আসায় প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে। চিকিৎসক খুব দ্রুত অপারেশন করতে বলেছেন। কিন্তু অর্থের অভাবে সেটি করাতে পারছেন না রেবেকা। দুর্ঘটনার দীর্ঘ ১০ বছর পার হয়ে গেছে। এরমধ্যে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে সন্তানের মা হয়েছেন। ছেলে মাদানী নূর (৪) প্লে শ্রেণিতে আর মেয়ে সিদ্রাতুন মুনতাহা (৯) তৃতীয় শ্রেণিতে স্থানীয় এক কিন্ডারগার্টেন স্কুলে লেখাপড়া করছে।
রেবেকা বেগমের স্বামী নির্মাণশ্রমিক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রানা প্লাজা ধসের দুই বছর আগে নিজেদের পছন্দে তারা বিয়ে করেছিলেন। তিনি সাভারে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন আর রেবেকা বেগম রানা প্লাজার পোশাক কারখানায়। রানা প্লাজা ট্রাজেডি তাদের সাজানো সংসার লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। তবে ব্র্যাক হিউম্যানিটারিয়ান প্রোগ্রামের আওতায় ৭ লাখ ২১ হাজার টাকা ব্যয়ে আলাদিপুর ইউনিয়নে বারাই এলাকায় ৫ শতাংশ জমির ওপর একটি দুর্যোগ সহণীয় বাড়ী নির্মাণ করে দিয়েছে।
এদিকে একই দুর্ঘটনায় নিখোঁজ হয়েছেন ফুলবাড়ী উপজেলার ৩নং কাজিহাল ইউনিয়নের কাজিহাল ডাঙা গ্রামের আতাউর রহমানের স্ত্রী গার্মেন্টসশ্রমিক গুলশান আক্তার শাবানা।
আতাউর রহমান বলেন, ঘটনার দিন সকালে রানা প্লাজায় গার্মেন্টেসের কাজে যোগ দেন তার স্ত্রী গুলশান আক্তার শাবানা। নিখোঁজদের তালিকায় শাবানার নাম থাকায় ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১৩ লাখ টাকা পেলেও পাননি তার স্ত্রীকে কিংবা তার মরদেহ।