ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিম খুন হয়েছেন বলে তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশের পুলিশ। ভারতে গিয়ে আনোয়ারুল আজিমের নিখোঁজের ঘটনায় তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি পুলিশ সূত্র জানায়, এ ঘটনায় সন্দেহভাজন দুজনকে পুলিশ বাংলাদেশে আটক করেছে। আটক হওয়া ওই দুই ব্যক্তি কলকাতা থেকে ফিরেছেন। আটক হওয়া দুজনের মধ্যে একজনের নাম আমানুল্লাহ সাইদ। সাইদের বাড়ি খুলনা ফুলতলা এলাকায়। পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ওয়ারী বিভাগের একটি দল কেরানীগঞ্জ থেকে আমানুল্লাহ সাইদ নামের একজনকে আটক করেছে। তারই জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যগুলো ভারতের একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে জানালে তারা জানায় যে আনোয়ারুল আজিম খুন হয়েছেন।
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) ও কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ারুল আজীম আনারের খন্ডিত দেহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। বুধবার (২২ মে) সকালে কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জিভা গার্ডেন্সের একটি ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয়। এমপি আনারের মৃত্যুতে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে শহরে চলছে শোকের মাতম। আনোয়ারুল আজীমের আত্মীয়-স্বজনসহ প্রতিবেশি ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জড়ো হয়েছেন তার বাড়ি ও দলীয় কার্যালয়ের সামনে। কালীগঞ্জ শহরের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়ন করা হয়েছে। গত ১২ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর২৪ পরগনা জেলার বরানগর থানার অন্তর্গত ১৭/৩ মন্ডলপাড়া লেনের বাসিন্দা এমপি আনারের দীর্ঘদিনের পরিচিত গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন তিনি। মূলত চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ থেকে ভারতে ওই বন্ধুর বাড়িতে যান এমপি আনার। আনোয়ারুল আজীম আনার ঝিনাইদহ-৪ আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে টানা তিনবার আওয়াামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, এমপি নির্বাচিত হওয়ার আগে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন ও পৌরসভার ২ বার কাউন্সিলার ছিলেন। তিনি এলাকার উন্নয়নে কাজ করে গেছেন। সংসদ সদস্য হিসেবে বিভিন্ন সেবামূলক কাজের জন্য তার সুনামও রয়েছে। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকার গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষের সঙ্গে দেখা করে সমস্যা শুনে সমাধান করতেন তিনি। তবে চলাচলের সময় কোনো পুলিশ প্রটোকল ব্যবহার না করে একা চলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। সব থেকে আলোচিত বিষয়, নির্বাচনী এলাকায় যে কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তার বাড়িতে যেতেন এবং শোকার্ত পরিবারকে শান্তনা দিতেন। এমনও হয়েছে তিনি একদিনে ১০ জন মৃত ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছেন।
বুধবার সকালে রাজধানীর বাড্ডায় এক অনুষ্ঠানে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, আনোয়ারুল আজিমের ঘটনায় বাংলাদেশের পুলিশ কলকাতার পুলিশের সঙ্গে কাজ করছে ও তারা যোগাযোগ রাখছে। আনোয়ারুল আজিমের একান্ত সচিব আবদুর রউফ বুধবার সকালে বলেন, ‘আমরা গণমাধ্যমের মাধ্যমে খুনের ঘটনা জানতে পেরেছি। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানা সম্ভব হচ্ছে না।
বুধবার দুপুরে এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারের বাসভবনের নিচে বিলাপ করছিলেন তার আত্মীয় কালীগঞ্জ পৌরসভার সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর বিনা খাতুন। তিনি বলছিলেন আমাদের সোনার জামাই কীভাবে চলে গেলো। যারা মেরেছে তারা টাকা পয়সা নিয়ে আমাদের জামাইকে ফিরিয়ে দিত। কেন ওইভাবে নিয়ে গেলো। সে তো কারও ক্ষতি করেনি। তাকে কেন মেরে ফেরা হলো। আমরা এর বিচার চাই।
পাশেই এমপি আনারের রাজনৈতিক কার্যালয়ের সিঁড়িতে বসে বিলাপ করছিলেন এমপির এক সহযোগী রুবেল হোসেন। তিনি বলেন, ভারতে যাওয়ার আগে তার সঙ্গে শেষ কথা হয়। তিনি বলেছিলেন গরিব মানুষের চেকগুলো তুলে রাখ। আমি ফিরে এসে চেকগুলো সব একসঙ্গে বিতরণ করবো। সে চলে গেলো, এখন এভাবে কে গরিব মানুষকে নিয়ে ভাববে। কে আর এভাবে কথা বলবে।ভারতে খুন হওয়ার খবর শুনে দলীয় কার্যালয়ে শত শত মানুষ কান্নায় ভেঙে পড়েন।এমপির নির্বাচনী এলাকা কালীগঞ্জ উপজেলার ১নং সুন্দরপুর দুর্গাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ওহিদুজ্জামান ওদু বলেন, তার মৃত্যু সংবাদ শুনে রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে এসেছি। তার মরদেহ ভারতে পাওয়া গেছে। কীভাবে তার মৃত্যুু হয়েছে তা বলতে পারছি না। এমপির সঙ্গে কারও কোনো বিরোধ ছিল না। কিন্তু তার জনপ্রিয়তা ছিল অনেক।
১২ মে সেখানে পৌঁছে পশ্চিমবঙ্গে বরাহনগর থানার অন্তর্গত মন্ডলপাড়া লেনে গোপাল বিশ্বাস নামে পরিচিত এক ব্যক্তির বাড়িতে ওঠেন। পরদিন ১৩ মে ডাক্তার দেখানোর জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। ১৫ মে বরাহনগরের বাসিন্দা গোপাল বিশ্বাসের হোয়াটসআপে মেসেজ করে জানান তিনি দিল্লি যাচ্ছেন। ১৬ মে এমপির ব্যক্তিগত গাড়ি চালক তরিকুল ইসলামের মুঠোফোনেও একটি মেসেজ পাঠিয়ে জানান দিল্লি যাওয়ার কথা। এরপর থেকে রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হন আনোয়ারুল আজীম আনার।
পুলিশ সূত্র জানায়, ভারতে গিয়ে ১২ মে সন্ধ্যা ৭টার দিকে আনোয়ারুল কলকাতায় তাঁর পূর্বপরিচিত বন্ধুসম্পর্কীয় গোপাল বিশ্বাসের বাসায় ওঠেন। গোপালের সঙ্গে তাঁর ২৫ বছরের পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। ১৩ মে বেলা ২টার (কলকাতার স্থানীয় সময়) দিকে আনোয়ারুল চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা বলে গোপাল বিশ্বাসের বাসা থেকে বের হন। তখন গোপালকে বলে যান, তিনি সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আসবেন। এরপর আর বাসায় না ফেরার কারণে ১৮ মে কলকাতার বরাহনগর থানায় গোপাল বিশ্বাস একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। গোপাল বিশ্বাস জিডিতে উল্লেখ করেন, আনোয়ারুল আজিমের সঙ্গে তাঁর ২৫ বছর ধরে পারিবারিক সম্পর্ক। ১২ মে সন্ধ্যা ৭টার দিকে আনোয়ারুল আজিম কলকাতার মন্ডলপাড়া লেনে তাঁর (গোপাল বিশ্বাস) বাড়িতে আসেন। তিনি কলকাতায় আসেন ডাক্তার দেখাতে। পরদিন (১৩ মে) স্থানীয় সময় (কলকাতা) বেলা পৌনে ২টার দিকে ডাক্তার দেখানোর জন্য গোপাল বিশ্বাসের বাড়ি থেকে বের হন আনোয়ারুল আজিম। যাওয়ার সময় তিনি (আনোয়ারুল) বলে যান, দুপুরে খাবেন না সন্ধ্যায় ফিরে আসবেন। পরে তিনি কলকাতা পাবলিক স্কুলের সামনে এসে নিজেই গাড়ি ডেকে চলে যান।
জিডির তথ্য অনুযায়ী, আনোয়ারুল আজিম সন্ধ্যায় গোপাল বিশ্বাসের বাসায় ফেরেননি। আনোয়ারুল আজিমের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে গোপালকে একটি বার্তা পাঠিয়ে জানানো হয়, বিশেষ কাজে তিনি দিল্লি যাচ্ছেন। সেখানে পৌঁছে তিনি ফোন করে গোপাল বিশ্বাসকে জানাবেন, গোপাল বিশ্বাসের ফোন করার দরকার নেই। পরে ১৫ মে স্থানীয় সময় বেলা ১১টা ২১ মিনিটে আনোয়ারুল আজিমের নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে আরেকটি বার্তা আসে। তাতে আনোয়ারুল আজিমের দিল্লি পৌঁছানোর কথা জানিয়ে বলা হয়, আমার সঙ্গে ভিআইপিরা আছেন,ফোন করার দরকার নেই।আনোয়ারুল আজিমের নম্বর থেকে একই বার্তা বাংলাদেশে তাঁর বাড়ির লোকজন এবং ব্যক্তিগত সহকারীকে পাঠানো হয়।
কলকাতা পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, আনোয়ারুল আজিম খুন হয়েছেন কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেন্সের একটি ফ্ল্যাটে। ১৭ মে আনোয়ারুলের মেয়ে গোপাল বিশ্বাসকে ফোন করে জানান,তাঁর বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। তারপর তিনি আনোয়ারুলের পরিচিতজনের ফোন করেন। কিন্তু তাঁর কোনো সন্ধান মেলেনি।বাংলাদেশের একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এমপি আনার একা ভারতে গেছেন বলে শুরু থেকে প্রচার করা হলেও আসলে তার সঙ্গে আরও দুজন ছিলেন। তারাও বাংলাদেশি বলে এখন পর্যন্ত তথ্য মিলেছে। সিসিটিভি ক্যামেরার কিছু ফুটেজে ভারতীয় গোয়েন্দারা এমন তথ্য পেয়েছেন। ওই দুই ব্যক্তি এমপি আজীমের দীর্ঘদিনের পরিচিত। তাদের বাড়ি এমপির এলাকায় বলে ধারণা করা হচ্ছে।গত ১২ মে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, দর্শনার গেদে বর্ডার দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন এমপি আনার। ইমিগ্রেশন শেষ করে ভ্যানে চড়ে ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন তিনি। এ সময় এমপি আনার নিল রংয়ের শার্ট পরিহিত ছিলেন। ভ্যানচালক আর এমপি আনার ছাড়া ভ্যানে আর কেউ ছিলেন না। পিছনে একটি ব্যাগ ছিল। সে ভিডিওটি গনমাধ্যমে প্রচার করেছিলেন এমপির গাড়ি চালক তরিকুল ইসলাম।