শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে বকেয়া বেতন পরিশোধ করেছে নগরীর বিসিক শিল্প নগরীতে অবস্থিত জুতা তৈরির প্রতিষ্ঠান ফরচুন সুজ লিমিটেড। একইসাথে শ্রমিকদের উত্থাপিত অন্যান্য দাবি মেনে নেয়ারও ঘোষণা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
ফলে শনিবার থেকে পুলিশের পাহারায় চালু করা হয়েছে জুতা রপ্তানিকারক এই প্রতিষ্ঠানটি। তবে দ্বিতীয়দিনের ন্যায় রোববার ও কিছু শ্রমিক অনুপস্থিত রয়েছেন। রোববার দুপুরে বরিশালের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মনদীপ ঘরাই বলেন, আন্দোলনরত শ্রমিকরা যেন চাকরিচ্যুত না হন সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি মেনেও নিয়েছে ফরচুন কর্তৃপক্ষ। তিনি আরও বলেন, ফরচুন সুজের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান সব শ্রমিকের সামনে এবং বৈঠকে আমাদের নিশ্চিত করেছেন শ্রমিকরা যেসব ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলন করেছেন তার সবই তিনি মেনে নিয়েছেন।
ফলশ্রুতিতে ফরচুনের তিনটি কারখানার প্রায় সাড়ে তিন হাজার শ্রমিকের এপ্রিল মাসের বেতনও পরিশোধ করা হয়েছে। পাশাপাশি কারখানার মধ্যে যারা শ্রমিকদের মারধর করতো বলে অভিযোগ উঠেছে তাদের বদলী করে কোম্পানির অন্য কারখানায় পাঠানো হয়েছে। শ্রমিকদের ওপর গুলির ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলা হয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আরও বলেন, শ্রমিক আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে শ্রমিকরা কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগগুলো তুলেছেন, সে বিষয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে রোববার কারখানা পরিদর্শন করা হয়েছে। এ ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
শঙ্কায় শ্রমিকরা ॥ জুতা উৎপাদনকারী ফরচুন কোম্পানীতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার শ্রমিক কাজ করেন। বিভিন্ন সময়ে অনিয়মের শিকার হলেও গত ২৩ মে প্রথম সব শ্রমিক ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করেন। ঘটনার পরপরই প্রশাসনের হস্তক্ষেপে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান শ্রমিকদের সব দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলেও তা বিশ্বাস করতে পারছেন না অনেকেই। শ্রমিকরা জানিয়েছেন, কারখানার ম্যানেজমেন্ট অনেক পাওয়ারফুল। তারা পরিস্থিতি সামলে উঠে আবার আগের রূপে ফিরে যাবে। তাই নানা শঙ্কা বিরাজ করশে শ্রমিকদের মধ্যে।
ঘটনার সূত্রপাত ॥ ফরচুন সুজে শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় বকেয়া বেতনের বিষয়টি সামনে আসলেও প্রথমে বিষয়টি অস্বীকার করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকরা জানিয়েছেন, ঘটনার সূত্রপাত কারখানার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের দ্বারা। তারা (আনসার) তাদের ক্যাম্পে আমাদের আন্দোলনরত কয়েকজন শ্রমিককে ধরে নিয়ে যায়। আমরা তা ছাড়িয়ে আনতে গেলে উত্ত্যপ্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়। তখন হঠাৎ করেই আনসার সদস্যরা গুলিবর্ষণ করে।
মিশ্র প্রতিক্রিয়া ॥ শ্রমিকদের আন্দোলনে আনসার সদস্যদের গুলিবর্ষণের ঘটনায় প্রশ্ন তুলে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) বরিশাল জেলার উপ-মহাব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম বলেন, শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলন করার প্রেক্ষিতে এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, যে তাদের ওপরে গুলিবর্ষণ করতে হবে। আনসার সদস্যরা গুলিবর্ষণের কাজটি বাড়াবাড়ি করেছে। এ কারণে আনসার ইউনিটকে বিসিক থেকে সরিয়ে নেওয়ারসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ পাঠানো হয়েছে।
শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন ॥ আন্দোলনরত শ্রমিকরা জানিয়েছেন, শুধু বকেয়া বেতনের দাবিতেই নয়; কারখানার মধ্যে পদে পদে শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন করে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এনিয়ে দীর্ঘদিন থেকে কারখানার মধ্যে শ্রমিকরা মালিক পক্ষের সাথে আলোচনার চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু ফরচুন সুজ কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের কথা এড়িয়ে গেছেন। এমনকি যারা শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছেন তাদের কারণ দর্শানো ছাড়াই চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ॥ কাউনিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আসাদুজ্জামান বলেন, ফরচুন সুজে শ্রমিক অসন্তোষকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনায় মালিক বা শ্রমিক কারো পক্ষ থেকেই থানায় অভিযোগ দেয়া হয়নি। তবে পুলিশি নিরাপত্তায় কারখানা চালু করা হয়েছে।
ফরচুন চেয়ারম্যানের দাবি ॥ ফরচুন সুজ কারখানার চেয়ারম্যান ও বিপিএলে ফরচুন বরিশাল টিমের মালিক এবং বিসিক শিল্পনগরী ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, কারখানার কর্মীদের মাঝে গুজব ছড়িয়ে দিতে ঘটনার দিন কিছু বহিরাগতরা এসে বলে চারজন কর্মী গুলিতে মারা গেছেন। ফলে শ্রমিকরা ক্ষিপ্ত হয়ে কারখানার মধ্যে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করে। পরে হাসপাতাল থেকে পুলিশ আহত কর্মীদের এনে সকলকে দেখান কর্মীদের চিকিৎসা চলছে এবং তারা বেঁচে আছেন। এরপরই বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা শান্ত হয়। তিনি আরও বলেন, শ্রমিকরা যে দুইজনের বিষয়ে অভিযোগ তুলেছেন আমি সাথে সাথে তাদের অন্যত্র বদলী করেছি। এ ছাড়া শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ইতোমধ্যে আমি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বরাবর লিখিত দিয়েছি। মিজানুর রহমান বলেন, ঢাকাতে আহত চারজনকে চিকিৎসা করানো হচ্ছে। এরমধ্যে দুইজন কারখানার কর্মী ও বাকি দুইজন বহিরাগত। তবে আমরা সকলেরই চিকিৎসা খরচ বহন করছি।
উল্লেখ্য, গত ২৩ মে বিকেলে নগরীর বিসিকে অবস্থিত ফরচুন সুজ কারখানায় কাজে যোগ দিয়ে মার্চ ও এপ্রিল মাসের বকেয়া বেতনের দাবি করেন শ্রমিকরা। তবে ফরচুন কারখানা কর্তৃপক্ষ জানায়, পুরো বেতন পরিশোধ করা সম্ভব নয়। ফলে কিছু শ্রমিক কাজে ইস্তফা দিয়ে কারখানা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজনকে ধরে নিয়ে আনসার ক্যাম্পে মারধর করা হয়। এ সময় অন্য শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে আনসার ক্যাম্পে ও ফরচুন কারখানায় হামলা চালায়। একপর্যায়ে আনসার সদস্যরা শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ করেন। এতে চারজন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হয়। অপরদিকে শ্রমিকদের ছোঁড়া ইট-পাটকেলে এক পুলিশ কর্মকর্তা ও ছয়জন আনসার সদস্য আহত হয়েছেন।